গল্পকার কৌশিক রেইনের অনন্য গল্প গ্রন্থ “রেশমি চুড়ি মন”

গল্পকার ও কবি কৌশিক রেইনের গল্প গ্রন্থ “রেশমি চুড়ি মন”। মোট ১২ টি গল্প বইটিতে স্থান পেয়েছে। বইয়ের পঞ্চম গল্প “রেশমি চুড়ি মন” নামটা দেয়া হয়েছে বইয়ের নাম। তুমি এসেছিলে বসন্ত ঘ্রাণে, মাতাল মৌ, নিন্দার কাঁটা, আলতা রাঙ্গা, স্বপ্নচারী, কাঞ্চনে অশ্রুবিন্দু, মধুরেণ সমাপাতে, মনের জাদুকর, শুভ পরিণয়, ভেঙ্গেছে আকাশ ওখানে ও যৌবনে মৌ লেখকের অন্যন্য গল্প।
বই রিভিউর বাস্তব কোনো ব্যাকরণ থাকে না আমি মনে করি। তবে রিভিউ লিখতে অবশ্যই কিছু বিষয় তো সামনে চলে আসে। বিশেষ করে রিভিউ লিখার মাধ্যমে একটা বইয়ের সারসংক্ষেপ তুলে ধরতে পারাটা মনে করি বইয়ের নিখুঁত চিত্র তুলে ধরা। বইটি যথেষ্ট মনোযোগের সাথে পড়েছি। নিজের স্টাইলে বইকে না বুঝে, লেখকের স্টাইলে বুঝেছি। লেখকের ইন্টেনশন ধরার চেষ্টা করেছি। লেখক এবং প্রকাশনীর ব্যাপারে প্রিডিটার্মাইন্ড লেগেছে। মূলতঃ বইটি সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলার জন্য রিভিউ লিখলাম পাঠকদের জন্য।

বইয়ের প্রথম গল্প “তুমি এসেছিলে বসন্ত”। এতে গল্পকার কৌশিক রেইন গল্প বুনেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেমে মজে এক সহপাঠি। সে নিয়ে প্রেম কাহিনী। প্রেমিকার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাওয়া। প্রেমিকের বিদেশ চলে যাওয়া। সেখানে পরিচয়ের সুবাধে এক সন্তানের জনক স্বামী পরিত্যক্তা এক সুন্দরী মহিলাকে বিয়ে করা। অন্যদিকে প্রেমিকার মন পুড়ে প্রেমিকের জন্য। প্রেমিকের জন্য প্রেমিকার বুকে হাহাকার। আবারও নতুন স্বপ্ন দেখা। এই সব মিলিয়ে অসাধারণ গল্প লেখক কৌশিক রেইন দারুনভাবে উপস্থাপক করেছেন।

লেখকের দ্বিতীয় গল্প “মাতাল মৌ”। তিনি সে গল্পে এক ধনাট্য ও নিলর্জ্জ শ্বশুরের এক অটিস্টিক সন্তানের স্ত্রীর কাছে অপরাগতায় বংশপ্রদিপ জালাবার দোহায় দিয়ে পুত্রবধুর সাথে বেহায়ার মত আস্ফালন পরে তার উরশে মৃত সন্তান প্রসব করে পুত্রবধুর করুণ মৃত্যুর চিত্র তুলে ধরেছেন।
লেখককের তৃতীয় গল্প “নিন্দার কাঁটা”। সে গল্পে বলতে না পারা অসম ভালবাসার অসাধারণ এক মর্মস্পর্শি গল্প উপস্থাপন।
চতুর্থ গল্প “আলতা রাঙ্গা” গল্পে লেখক এক কিশোরীর পাখির প্রতি অদম্য ভালোবাসার নির্মল চিত্র তুলে ধরেছেন। গল্পের ধরণটা একটু না বললেও নয়। এক গ্রামের সহজ সরল কিশোরীর পাখিদের প্রতি অকৃত্রিম প্রেমের বনার্ণা তুলে ধরা হয়েছে। সে হাঁস পালন করতো আদরের সাথে। কিন্তু বাধ সাধে তরুণ বয়সী শহরের ছেলেরা ঐ হাঁস রেঁধে পিকনিক করার আকাংঙ্খা। এরপর হতে তাঁর একটি হাঁস পাওয়া যাচ্ছিল না, তবে পরে পেয়ে কেঁদেছে দুচোখে অজোরধারায়।
“রেশমি চুড়ির মন” গল্পে গল্পকার ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা অতঃপর না পাওয়ার বেদনায় দু’চোখে পানি। এটিও দারুণ গল্প ও হৃদয়গ্রাহী। এ গল্পটি বইটির সেরা গল্প বললেও ভুল েেহব না। তাই তো এই গল্পের নামেই নামকররণ করা হয়েছে বইয়ের নাম।
এর পরের গল্প “স্বপ্নচারী”। এই গল্পে লেখক দুঃখের মাঝে থাকা এক সংসারের করুণ ইতিহাস আঞ্চলিক ভাষাকে বাংলায় তুলে ধরেছেন এমন ভাবে, যা পাঠক হৃদয়ে দোলা দিবে অনন্য মাত্রায়। গল্পটি পাঠ করতে গিয়ে কোথায় জানি চলে গিয়েছিলাম।
“কাঞ্চনে অশ্রুবিন্দু” গল্পকার মর্ম্মান্তিক একটি গল্প উপস্থাপন করেছেন। নবম শ্রেণীর এক কিশোরীকে জোরপূর্বক রেপ করার কাহিনি। গা চমচম করা গল্পের শেষ দিকে মনটা খারাপ হয়ে গেল। দোষীর ব্যক্তির শাস্তির বিষয়ে কিশোরীটির না। আর সেটা কেন বলা আমাদের কুলশিত এই সমাজে ভাবনার বিষয়।
“মধুরেণ সমাপেত” গল্পে লেখক কৌশিক রেইন অন্য রকম সারপ্রাইজ দেন গল্পে পাত্র-পাত্রীকে বিয়ে দিয়ে। গল্পটি পড়তে পড়তে আমি তাঁর অন্য গল্পের মতো এই গল্পও হবে মনে করেছিলাম। কিন্তু না লেখক এমন গল্প লিখেন যা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। অসাধারণ লিখন শক্তির প্রকাশ বলা যায়।
“মনের যাদুকর” লেখকের নবম গল্প। দুই লেখকের হৃদ্যতাপূর্ণ সময় গল্পে গল্পে বিদিত করা হয়েছে। এতে অসারধারণ চিত্র ফুটে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। যা পাঠক হৃদয়কে নাড়া দেবে নিশ্চিত।
কৌশিক রেইনের আর একটি অনবদ্য গল্প “শুভ পরিণয়”। এই গল্পে লেখক চিরাচরিত ও স্বভাবসূলভ লিখন শৈলীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন, নানা প্রতিকুলতা পেরিয়ে এক বিবাহের সুন্দর সম্পন্ন হওয়া গল্প ।
“ভেঙ্গেছে আকাশ ওখানে” গল্পকারের অন্যরকম একটি গল্প। অসম এক প্রেমের সম্পর্ক ভেঙ্গেছে। তাই বিষণœ এক মানুষের নতুন করে ভাবনার উঁকি। কিন্তু তিনি কি করবেন বুঝে উঠতে না পারার এটি সুন্দর একটি গল্প।
বইটির একেবারে শেষ গল্প “যৌবনে মৌ”। লেখকের এই গল্পটা ভালোবাসার। গল্পটি ভালবাসার মানুষকে কাছে না পাওয়া কাহিনি নির্মিত। পুরো গল্পটা দারুণভাবে শেষ করেছে গল্পকার কৌশিক রেইন। এটি অসাধারণ একটি গল্প। স্বামী মারা যাওয়া এক ভদ্র মহিলার সুন্দরী মেয়েকে প্রাইভেট টিউটরের সর্বনাশ করার গল্প তুলে ধরা হয়েছে।
এই বইটি পাঠকদের পড়া উচিৎ এ কারণে যে, গল্পকার কৌশিক রেইন সব গল্পে অসাধারণ গল্পকাঁথা বুনেছেন যা পাঠক হৃদয়কে চম্বুকের মতো টানতে সক্ষম।
গল্পকার কৌশিক রেইন ২১ জুন চট্টগ্রামের হেমসেন লেইনের নিজ পৈত্রিক বাড়িতে পিতার গৃহে জন্ম গ্রহণ করে। তাঁর পিতা একজন চিকিৎসক ও মাতা সংস্কৃতি সেবার পাগল। লেখকের শৈশোব কেঁটেছে সেন্ট মেরিস স্কুলে। চট্টগ্রাম কলেজ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর করে মহান পেশা শিক্ষকতার সাথে এখন যুক্ত রয়েছেন। সেই সাথে পত্র-পত্রিকায়, লিটলম্যাগ ও সাপ্তাহিকীতে নিয়মিত লেখে চলছেন। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ এটিসহ মোট তিনটি কাব্যগ্রন্থ; “ভিজেছি মনের বৃষ্টিতে” ও “আমার আকাশে শুধু একটি নক্ষত্র”। দুইটি গ্রন্থই ২০১৯ এ একুশের গ্রন্থ মেলায় পাঠক নন্দিত হয়েছিল। ২০২১ এ বের হলো “রেশমি চুড়ি মন”। গল্পকার কৌশিক রেইন লেখার প্রতি গভীর টানেই সাহিত্য জগতে বিচরণ। আমরা তাঁর আরো সুদূর যাত্রা প্রত্যশা করছি।
পরিশেষে বলতে চাই, লেখক যা লিখেছেন তা নিয়েই রিভিউ করেছি। বই থেকে প্রত্যাশা তা রিভিউতে আমি লিখি নাই। কারণ
ততটুকুই লিখেছি যতটুকু লেখক কভার করেছেন। ইলাস্টিকের মতো টেনে বড় করি নাই। লেখক ও বইয়ের মূল ফোকাসটা ধরেছি।
চার রঙ্গে অসাধারণ প্রচ্ছদে বইটি নান্দনিক অরঙ্করণ করেছেন হৃদয় হাসান বাবু। নিখুত ছাপা এ-ফোর সাইজের বইটি স্বাধীন প্রকাশনের ব্যানারে প্রকাশক করেছেন মো. সাহাব উদ্দীন হাসান বাবু। পরিবেশক শব্দশিল্প প্রকাশন ও সাহিত্য বিচিত্রা, চট্টগ্রাম। প্রধান পরিবেশক স্বাধীন কিডস উইংস, চট্টগ্রাম। বইটির মূল্য রাখা হয়েছে মাত্র একশত টাকা।
রিভিউ লেখক: তসলিম খাঁ, কবি-গল্পকার ও বিভাগীয় সম্পাদক – মাসিক ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।