ঘুরে দাঁড়াচ্ছে অর্থনীতি টিকার গতি বাড়ানোর পরামর্শ

করোনা মহামারির প্রভাবে স্থবির হয়ে পড়েছিল দেশের সার্বিক অর্থনীতি। নজিরবিহীন সংকটে পড়েছিল রপ্তানি খাত সহ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো। আশার কথা- অতিমারির সব ক্ষতি ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠছে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত রপ্তানি খাতসহ দেশের সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। তবে কিছু ঝুঁকিও রয়েছে সামনে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এই ঝুঁকি মোকাবিলায় বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ। তারা বলছেন, এরমধ্যে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো দেশের সব মানুষকে সময়মতো শত ভাগ করোনার টিকার আওতায় আনা। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সরবরাহ ব্যবস্থার সমস্যার সমাধান।

এছাড়া ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া ধরে রাখতে কোভিডকালীন সংকটে পড়া সব খাতগুলো দ্রুত সংস্কারের পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের। তবে সময় মতো শতভাগ টিকা নিশ্চিত করা না গেলে নতুন করে করোনার ঢেউ আসলে তখন আবারও ভেঙে পড়তে পারে দেশের ঘুরে দাঁড়ানো অর্থনীতি; এমনটিই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, করোনা মহামারি একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। সংক্রমণ আবারও বাড়তে পারে। তাই ঘুরে দাঁড়ানো অর্থনীতির সূচক ধরে রাখতে হলে সর্ব প্রথম টিকা কার্যক্রম শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। এটিই বাংলাদেশের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ। তিনি মানবজমিনকে বলেন, কোভিড সংক্রান্ত ঝুঁকি এখনো কাটেনি। এখন ইউরোপেও কিছু কিছু দেশে লকডাউন চলছে। সেদিন মস্কোতে লম্বা লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। কাজেই এখন কোভিড প্রতিরোধ গড়ে তোলাটা গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো টিকা কার্যক্রম। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত আড়াই কোটির মতো মানুষ টিকা পেয়েছেন। কিন্তু এটিকে আরও এগিয়ে নিতে হবে। বলা হয়েছে আগামী মার্চের মধ্যে ৮০ শতাংশ সম্পন্ন করতে হবে। তবে পারলে সেটা আরও আগে অর্জন করা যায় কিনা দেখতে হবে। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, কোভিড তো আর একেবারে চলে যাবে না। আবারও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেজন্য সবাইকে টিকা দিতে হবে। একইসঙ্গে বুস্টার ডোজও নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, একবার দিলেই যে কোভিড থেকে শঙ্কামুক্ত হয়ে যাচ্ছেন- তাতো না। তাই করোনা থাকলেও এর সঙ্গে বসবাসের শক্তি গড়ে তুলতে হবে বলে মত দেন জাহিদ হোসেন।

 

দেশের বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, করোনা পরবর্তী অবশ্যই ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ইনফরমাল সেক্টরে কোভিডের কারণে দেশের যে খাতটি সবচেয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল সেটি হলো সেবা খাত। বিশেষ করে শহরের কর্মকাণ্ড এখন স্বাভাবিক হয়েছে। যেমন চায়ের দোকান থেকে শুরু করে রিকশাওয়ালা, নাপিতসহ সব ধরনের কর্মকাণ্ড এখন স্বাভাবিকভাবেই চলছে। খুচরা বাজারগুলোতে ক্রেতাদের সমাগম বেড়েছে। অর্থাৎ সবকিছুরই একটা দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে রপ্তানিতে সেপ্টেম্বর থেকে পরিসংখ্যানেও ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ একেবারে স্পষ্ট। শোনা যাচ্ছে যে, আগামী মার্চ পর্যন্ত যে উৎপাদন ক্ষমতা আছে, সেটার জন্য যে অর্ডারের প্রয়োজন সেগুলো তাদের কাছে আছে। তবে যে অর্ডারগুলো আছে, সেগুলো ডেলিভারি নিয়ে অনেকে শঙ্কিত। কারণ, বন্দরে কন্টেইনার জট বড় একটা সমস্যায় ফেলেছে। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই ঢাকা বিমানবন্দরে যেসব স্ক্যানার মেশিন আছে সেগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। কাজেই, এখনতো সারা বিশ্বেই সাপ্লাই চেইনে বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেজন্য তাদের অর্ডারগুলো যদি সময়মতো পাঠাতে না পারে তাহলে রপ্তানি খাতে বড় সমস্যা দেখা দেবে। দেশের অর্থনীতির সামনে এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ঠিক আছে, কিন্তু এটিকে টিকিয়ে রাখতে হবে। যদি কোভিডের তৃতীয় আরেকটি ঢেউ আসেও, তাতে যেন অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

 

অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালেও বাংলাদেশের সামনে দুইটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মত দেন জাহিদ হোসেন। তার মতে, সবাইকে টিকা দেয়া। তারপর বুস্টার ডোজের ব্যবস্থা করাই হলো প্রধান চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয়ত, ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়াকে টেকসই করতে হলে বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে যে সমস্যা আছে, সেগুলোর দিকে বেশি নজর দিতে হবে। অর্থাৎ বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো। আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা যথাযথভাবে নিশ্চিত করা। এছাড়া কোভিডের সময় যে সংকটগুলো ছিল, সেগুলোর দিকে প্রথমে নজর দেয়া যায়নি, কারণ এটি ছিল ইমার্জেন্সি কেস। এখন সেগুলোতে নজর দেয়া। বিশেষ করে যেগুলো সংস্কার করা হচ্ছিল, সেগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

 

সাম্প্রতিক বিভিন্ন পরিংসংখ্যানে দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, অতিমারির প্রভাব কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে রপ্তানি আয়ে। করোনার মধ্যেও গত অর্থ বছরে রপ্তানি খাতে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রপ্তানি বেড়েছে ১১ শতাংশ। এতে গতি ফিরেছে দেশের সার্বিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে। পরিসংখ্যানে আরও জানা যায়, করোনোর মধ্যেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের অর্থনীতিতে সাড়ে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সাময়িক হিসাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ। রাজস্ব আয় বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ, যা ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফিরে আসার লক্ষণ বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞরা। ওদিকে রেমিট্যান্স আয়ে গত কয়েক মাসে ধীরগতি থাকলেও গত অর্থবছরে রেকর্ড ৩৬ শতাংশ বেড়েছিল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৪৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

 

বিশ্বব্যাংকের এক পরিসংখ্যান বলছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ আরও বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৯ শতাংশের পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সর্বশেষ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক বলছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১৩৯ ডলার। অন্যদিকে, ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১১৬ ডলার। সেই হিসাবে ভারতকে পেছনে ফেলবে বাংলাদেশ।