ছোট ছোট নেক আমল ও দোয়া বদলে দিবে জীবন

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, মানবতার মুক্তির দূত, সাইয়্যেদুল মুরসালিন খাতামুননাবিয়ীন হযরত মুহাম্মদ (সা:) কে আল্লাহ ছোবাহানাহু তায়ালা বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন-তোমাদের জন্য রাসুলের জীবনীর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। তাঁর প্রতিটি কথা, কাজ, অনুমোদন, নির্দেশনা, আদেশ, নিষেধ ও উপদেশ দুনিয়া-আখেরাতের কল্যাণের বার্তাবাহী। তিনি গোটা মানব জাতির শিক্ষক। তাঁর সে কালজয়ী আদর্শ ও অমিয়বাণী দ্যুাতি ছড়িয়ে পথপদর্শন করেছে যুগ যুগান্তরে, আলোকিত হয়েছে মানবমন্ডলী।
আমরা অনেক ছোট বিষয়কে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখি। অর্থবিত্তে ছোট, প্রভাব-প্রতিপত্তিতে ছোট, বংশমর্যাদায় ছোট, সামাজিক সম্মানের বিবেচনায় ছোট, শিক্ষা-দীক্ষায় ছোট, বয়সে ছোট এমন যত ছোট’ রয়েছে সবই যেন আমাদের দৃষ্টিতে খানিকটা অবহেলার পাত্র। অনেক সময় বয়সে বড়রা ছোটদের অবহেলা করে। সম্পদশালীরা দরিদ্রদের তাচ্ছিল্য করে। বিদ্যাবুদ্ধিতে যারা অগ্রসর, তারা অনগ্রসরদের ছোট করে দেখে। সন্দেহ নেই, এতাচ্ছিল্য ও অবহেলার দৃষ্টি অবশ্যই নিন্দনীয়।
আমাদের জীবন চলার পথে পথে, ঘরে-বাইরে নানা জায়গায় ছোট ছোট পুণ্যময় এমন অনেক কিছু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। যেগুলো নিজ নিজ ক্ষুদ্রতাসহই সফলতার পথে আমাদের পৌঁছে দিতে পারে অনেক দূর। আবার এমন অনেক ছোট ছোট পাপের কাজও রয়েছে, যেগুলো ক্ষুদ্র হলেও আগুনের ফুলকির মতো জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারে আমাদের ইমান-আমল সবকিছু। দৃশ্যত ক্ষুদ্র এসব পাপ-পুণ্য নিয়েই আমার আজকের আলোচনা।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে, সে তা দেখবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে, সে তাও দেখবে।’ (সুরা জিলজাল, আয়াত : ৭-৮)
বিচারের দিন ছোট কোনো আমল ও অনেক মূল্যবান হয়ে যাবে। তাই ছোট ছোট নেক কাজকে অবহেলা করা উচিত নয়। কারণ ইখলাসের সঙ্গে ছোট ছোট আমলই এনে দিতে পারে আখিরাতে মুক্তি লাভ।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমার ইমানকে খাঁটি করো, অল্প আমলই নাজাতের জন্য যথেষ্ট হবে।’ (মুসতাদরাকে হাকেম : ৭৮৪৪)
অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কোনো ভালো কাজকে কখনোই তুচ্ছজ্ঞান কোরো না। এমনকি তোমার ভাইয়ের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় সাক্ষাৎ করার ক্ষেত্রেও।’ (সহিহ মুসলিম : ১৪৪)
আমরা অনেকেই না জানার কারনে ছোট ছোট আমলের মাধ্যমে বেশি বেশি (নেকী) সওয়াব অর্জন করা থেকে বঞ্চিত হই। অল্প পরিশ্রমে বেশি সওয়াব অর্জন করার কিছু সহজ উপায় আছে। যে উপায় গুলো কাজে লাগালে আমাদের নেক আমলের পাল্লা ভারি হবে। আমরা অনেক সময় অহেতুক সময় অপচয় করি। প্রতিদিনের আমল হিসেবে আমরা কিছু ছোট দোয়া পড়ে সময় গুলোকে কাজে লাগাতে পারি। ফজিলতপূর্ণ কিছু নেক আমল ও দুয়া (ফাজায়েলে আমল) তুলে ধরার চেষ্টা করেছি আমাদের এই নিয়েই আজকের আলোচনা।
ছোট খাটো কিছু আমল, দুয়া আর হাদিস আপনার বর্তমান অবস্থাকে পরিবর্তন করে দিতে পারে। প্রসঙ্গত, নিয়মিত কোনো আমল যদি ছোটও হয়, ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘদিন করার ফলে এ ছোট আমলটির প্রতিদানও হয়ে যায় পাহাড়সম। আর ছোট আমল হলেও তা নিয়মিত করা আল্লাহ পছন্দ করেন।
নিচের ছোট ছোট আমলগুলো আমরা চাইলে অতি সহজেই করতে পারি। রাসূল সা:-এর সুন্নাহর অনুসরণ দিন দিন আমাদের চরিত্রকে সুন্দর করতে শুরু করবে। প্রতিটি আমলের মধ্য থেকে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে কোন আমলটি বেশি পছন্দনীয় হয় তা আমরা জানি না। সুতরাং আমাদের উচিত আমল ছোট হোক কিংবা বড় হোক, বেশি হোক কিংবা অল্প হোক তা করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা। যদি ছোট ছোট আমল থেকে আমাদের পরিবর্তনের যাত্রা শুরু করি, বৃহৎপরিবর্তনের দ্বার উন্মোচন হতে শুরু করবে, ইনশাআল্লাহ।

১. আমাদের যেহেতু নিয়মিত কাপড় পরিধান করতে হয়, প্রথমে ডান হাত এবং ডান পায়ের ব্যবহার দিয়ে শুরু করতে তো পারি। আগে বাম হাত ও বাম পা ব্যবহার না করলেও তো পারা যায়। হাদিসে এসেছে, রাসূল সা: জামা-পায়জামাসহ সব ধরনের পোশাক পরিধানের সময় ডান হাত ও ডান পা আগে ব্যবহার করতেন (আবু দাউদ, হাদিস -৪১৪১)।

২. আমাদের পায়ে যেহেতু নিয়মিত জুতা ব্যবহার করতে হয়, প্রথমে ডান পা দিয়ে পরিধান এবং জুতা খোলার সময় প্রথমে বাম পা দিয়ে শুরু করতে তো পারি। হাদিসে এসেছে, রাসূল সা: জুতা পরিধানের সময় ডান পা এবং জুতা খোলার সময় প্রথমে বাম পা ব্যবহার করতেন (সহিহ বুখারি, হাদিস -৫৮৫৫)।

৩. আমাদের যেহেতু প্রায়ই থুথু ফেলতে হয়, পশ্চিম দিকে না ফেলে অন্য দিকেও তো ফেলা যায়। এতে তো আমাদের আলাদা কষ্টের প্রয়োজন পড়ে না। হাদিসে এসেছে, রাসূল সা: বলেন, কিবলার দিকে যে কফ ফেলে তার চেহারায় ওই কফ থাকা অবস্থায় সে ব্যক্তিকে কিয়ামতের দিন পুনরুত্থিত করা হবে (সহিহ বুখারি-৪০৭; সহিহ মুসলিম-১২৫৫; বাজজার-৫৯০৪; ইবনে খুযাইমাহ-৮৮০; ইবনে হিব্বান-১৬৩৮; সহিহ তারগীব-২৮২)

৪. আমাদের যেহেতু নিয়মিত ঘুমাতে হয়, ডান কাত হয়ে শুইলে তো আর সমস্যা হয় না; বরং উপকারই হয়ে থাকে। মেডিক্যাল সায়েন্সও তাই বলে। হাদিসে এসেছে, রাসূল সা: যখন শয়ন করতেন তখন ডান কাত হয়ে শয়ন করতেন (বুখারি-৬৩১১; মুসলিম-২৭১৪)।

৫. পানি যেহেতু আমাদের সব সময় পান করতে হয়, একটু বসে খেলে তো বেশি পরিশ্রম হয় না। যেহেতু পান করবই, এক নিঃশ্বাসে না করে তিন নিঃশ্বাসেও তো পান করা যায়। এতে শুধু উপকারই হয়ে থাকে। মেডিক্যাল সায়েন্স এর উপকারিতার কথা বলেছে। হাদিসে এসেছে, হজরত আনাস রা: বলেছেন, রাসূল সা: দাঁড়িয়ে পান করা থেকে নিষেধ করেছেন (মুসলিম-৩৭৭২; তিরমিজি-১৮০০)।

৬. বাড়িতে এবং মসজিদে যেহেতু আমাদের সবসময় প্রবেশ করতে হয় এবং বের হতে হয়, ডান পা দিয়ে প্রবেশ এবং বাম পা দিয়ে বের হলে তো তেমন কঠিন হয় না। হাদিসে এসেছে, রাসূল সা: মসজিদে প্রবেশের সময় ডান পা ও বের হওয়ার সময় বাম পা ব্যবহার করতেন (হাকিম-১/২১৮; বাইহাকি-২/৪৪২)।

৭. স্মার্ট ফোনে ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, টুইটার, ইউটিউব ইত্যাদি অ্যাপস দীর্ঘক্ষণ ব্যবহারে সময় ব্যয় করে থাকি। কুরআন অ্যাপসে একটু সময় দিতেই তো পারি।

৮. আমরা যেহেতু নিয়মিত পথ দিয়ে চলাচল করে থাকি, পথের কষ্টদায়ক বস্তু দেখলে তা সরিয়ে দিতেও তো পারি। একটু কষ্টের ফলে সবার জন্য কল্যাণই বয়ে আনে। হাদিসে এসেছে, রাসূল সা: রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং তা ঈমানের সর্বনি¤œ শাখা হিসেবে উল্লেখ করেছেন (তিরমিজি-১৯৫৬; বুখারি-৬২২৯; মুসলিম-৩৫)।

৯. প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যেহেতু আমাদের শৌচাগারে যেতে হয়, প্রবেশের ক্ষেত্রে বাম পা এবং বাহির হতে ডান পা ব্যবহার করতে তো পারি। হাদিসে এসেছে, রাসূল সা: শৌচাগারে বাম পা দিয়ে প্রবেশ করতেন এবং ডান পা দিয়ে বাহির হতেন (আবু দাউদ, হাদিস-৩২)।

১০. আমাদের যেহেতু নিয়মিত প্যান্টস (পায়জামা) পরিধান করতে হয়, টাখনুর উপর পরিধান করতেই তো পারি। টাখনুর উপর পরিধান করতে তো তেমন অসুবিধা হয় না; বরং একটু নিচে পরিধান না করে সামান্য উপরে পরিধান করার মধ্যে স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকার রয়েছে। মেডিক্যাল সায়েন্স তার প্রমাণ নিশ্চিত করেছে। হাদিসে এসেছে, রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে কোনো পোশাক পরিধান করবে, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তার প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না (বুখারি-৫৭৮৪; আবু দাউদ-৪০৯৩; ইবনে হিব্বান-৫৪৪৭)। অন্য এক বর্ণনায়, রাসূল সা: বলেছেন, কাপড়ের যে অংশ টাখনুর নিচে যাবে, সে অংশ জাহান্নামে যাবে।
মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ভালোবাসেন। তাই তাঁর বান্দাদের ছোট ছোট অনেক আমলের বিনিময়ে অফুরন্ত সওয়াব দান করেন। মুমিনের কয়েক সেকেন্ডের আমলের বিনিময়ে তিনি তাদের জন্য জান্নাতকে সাজিয়ে তোলেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, যে লোক (একবার) বলে ‘সুবহানাল্লাহিল আজিম ওয়াবিহামদিহি’, তার জন্য জান্নাতে একটি খেজুরগাছ লাগানো হয়। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৬৪)
ছোট এই বাক্যটি পড়তে মাত্র তিন সেকেন্ডের কম সময় লাগে। কিন্তু আল্লাহ এতই মহান যে তিনি এর বিনিময়ে তাঁর প্রিয় বান্দার জন্য জান্নাতে খেজুরগাছ লাগিয়ে দেন। এমন ছোট অনেক আমলের মাধ্যমে বান্দা জান্নাতের মেহমান হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করতে পারে।
আবু উমামাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি প্রতি ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসি পড়বে তাকে মৃত্যু ছাড়া আর কোনো কিছু জান্নাতে যেতে বাধা দিতে পারবে না। (তাবরানি, হাদিস : ৭৫৩২, সহিহুল জামে, হাদিস : ৬৪৬৪)
প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর একবার আয়াতুল কুরসি পড়তে ১৫ সেকেন্ডের বেশি সময় লাগার কথা নয়। আল্লাহ এতই মহান যে তিনি তাঁর বান্দার মাত্র ১৫ সেকেন্ডের আমলের বিনিময়ে তাকে জান্নাতের মেহমান বানিয়ে নেন।
কিন্তু আমরা সবাই জানি যে যাদের অন্তরে শিরকের বিষ থাকবে মহান আল্লাহ তাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন না। রাসুল (সা.) তাঁর সাহাবিদের এমন একটি দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন, যে আমলটি করতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড প্রয়োজন হয়।
এ ছাড়া আরেকটি এমন আমল আছে, যার মাধ্যমে কয়েক সেকেন্ডে সব কবিরা গুনাহ থেকে পবিত্র হওয়া যায়। জায়েদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, যে লোক বলে, (আসতাগফিরুল্লাহাল আজিম আল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুমু ওয়া আতুবু ইলাইহি) ‘আল্লাহ তাআলার কাছে আমি ক্ষমা চাই, যিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, যিনি চিরজীবী, চিরস্থায়ী এবং আমি তাঁর কাছে তাওবাহ করি’, তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়, যদিও সে রণক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে থাকে। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৭৭)
ছোট ছোট আমলের মধ্যে অনেক কল্যাণ নিহিত থাকে। যদি এরূপ আমলের মাধ্যমে নিজেদের চরিত্র সুন্দর করতে চেষ্টা করি তাহলে আমাদের প্রধান বিষয়গুলো অনুসরণ করা অভ্যাসে পরিণত হয়ে উঠবে। ছোট্ট আমলের বিপরীতে ভালো কিছুর উপস্থিতি বিরাজমান। হাদিসে এসেছে, রাসূল সা: বলেন, আমি এক ব্যক্তিকে জান্নাতের গালিচায় গড়াগড়ি খেতে দেখলাম (অর্থাৎ শান্তি ও আরামের সাথে সুখময় জীবন কাটাচ্ছে)। মানুষের চলাচলের পথে একটি গাছ ছিল, যার কারণে চলাচলে কষ্ট হচ্ছিল। এ ব্যক্তি তা কেটে দিয়েছিল। ফলে আল্লাহ খুশি হয়ে তাকে জান্নাতে দাখিল করেন (সহিহ মুসলিম, হাদিস-১৯১৪)।
সুবহানাল্লাহ এভাবেই মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের পাপমুক্ত করে জান্নাতে প্রবেশ করানোর জন্য অবারিত সুযোগ রেখে দিয়েছেন। আমাদের দায়িত্ব সেগুলো লুফে নেওয়া।
অতএব, উপরিউক্ত হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা চাইলে এই ছোট্ট আমলের মাধ্যমে আমাদের ক্ষমা করে দিতে পারেন এবং জান্নাতে বসবাসের সুযোগও করে দিতে পারেন। ছোট ছোট নেক আমল জীবনকে বদলে দিবে ইনশাআল্লাহ।
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সঠিক বোঝার ও আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক :
এস এম ফখরুল ইসলাম নোমানী (মোরশেদ)
হেড অব ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস
এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেড