শিল্প কারখানার দূষণ রোধঃ শুধুই কি সামাজিক দায়বদ্ধতা?

মুহাম্মদ আলী আরশাদ চৌধুরী:: শিল্প-কারখানার মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ নতুন নয়। পানি, বায়ু কিংবা শব্দ দূষণ হরহামেশাই হয়। সবুজায়নে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানসমুহের অবদান অনস্বীকার্য। মুনাফার একটা অংশ সামাজিক দায়বদ্ধতার বিবেচনায় ব্যয় হচ্ছে বৃক্ষরোপন কর্মসূচিতে। কিন্তু পরিবেশ দূষণ রোধে শিল্প প্রতিষ্ঠানসমুহের পদক্ষেপ কি শুধুই সামাজিক দায়বদ্ধতা?

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ ও বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭ কার্যকর হওয়ার পর থেকে দূষণকারী বিভিন্ন ইউনিট বিশেষ করে শিল্প-প্রতিষ্ঠানসমুহ দূষণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্যোগী হয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালার ধারা-৭ অনুযায়ী কমলা-ক, কমলা-খ ও লাল শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত সকল শিল্পকারখানাকে পরিবেশ ছাড়পত্র পেতে হলে পরিবেশ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা রিপোর্ট ও পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব কমানোর পরিকল্পনা দিতে হবে। এছাড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী দূষণরোধক ও নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি কারখানার পরীক্ষামুলক উৎপাদনের পূর্বে স্থাপন করতে হবে। আইন অমান্যকারীর বিরুদ্ধে পরিবেশ আইন ১৯৯৫ এর ধারা ৪(৩) অনুযায়ী অধিদপ্তরের ডিজি ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার রাখেন। ২০০২ সালের সংশোধনী অনুসারে ধারা ১৫ মতে আইন অমান্যকারীর সর্বোচ্চ ১০ বছরের জেল ও ১০ লক্ষ টাকার জরিমানার বিধানও আছে।

স্বল্প জনবল নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর শিল্প কারখানার দূষণ রোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করলেও দপ্তরের তথ্যানুযায়ী২০১০ ইং থেকে ২০১৮ সালের মে মাস পর্যন্ত এনফোর্সমেন্টের অধীনে ৩৬৩২ টি প্রতিষ্ঠান ছিল। এসময় পরিবেশ দূষণের দায়ে প্রায় ২৫১.৬৪ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চার্জ করা হয় যার মধ্যে ১৬০.৭৭ কোটি টাকা আদায়ও করা হয়। শিল্প কারখানা কর্তৃক নদী দূষণের দায়ে প্রায় ১১১.৬৮ কোটি টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। উল্লেখিত সময়ে ২১৮২ টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের পানি দূষণ রোধে ইটিপি স্থাপন প্রয়োজন ছিল যার মধ্যে ১৬৭৬ টি প্রতিষ্ঠানের ইটিপি রয়েছে এবং বাকিগুলোর ইটিপি বাস্তবায়নের পথে।

তথ্যসমুহের উপস্থাপন করার উদ্দেশ্য ছিল পরিবেশ দূষণ রোধে শিল্প-কারখানার গৃহীত পদক্ষেপ সামাজিক দায়বদ্ধতার মাঝে সীমিত নয় বরং এটি কারখানার অন্যান্য মুখ্য উপাদানের মতোই একটি। রীতিমতো একের পর এক আইন ( পরিবেশ আদালত আইন ২০১০, ওজোনস্তর ক্ষয়কারী দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৪, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৬, বিপদজ্জনক বর্জ্য ও জাহাজভাঙার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০১১, প্রতিবেশগত সংকাটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০১৬, বাংলাদেশ জীব বৈচিত্র্য আইন ২০১৭) প্রনয়ন করে দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকার বদ্ধপরিকর। কিন্তু পরিতাপের বিষয় আইন করে শিল্প কারখানার দূষণ রোধ করলেও তা বাস্তবায়নে আর্থিক প্রণোদনা ও পরিকল্পনার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে এটি কার্যকরী ভুমিকা রাখতে সহায়ক হচ্ছে না।

সাম্প্রতিক সময়ে সাসটেইনেবলিটি জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে পানিদূষন রোধে ব্যবহৃত ইটিপি’র (50 m3/h capacity) গড় সংস্থাপন ব্যয় প্রায় ২.৫২ কোটি টাকা ও গড় বাৎসরিক পরিচালনা ব্যয় প্রায় ১.৩৯ কোটি টাকা। এছাড়া ইটিপি আমাদের লোকাল মার্কেটে এভেয়লেবল না, আমদানি করতে হয়। অনেক সময় বিদেশি ক্রেতার পছন্দসই দেশ থেকেই আমদানি করতে হয় এটি। আমদানির গড় খরচ প্রায় ১.৭২ কোটি টাকা। ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরের তথ্যানুযায়ী ইটিপি’র কাস্টমস শুল্ক ছিল ২৬.২৭%, সাথে শিপিং ব্যয়, পরিবহন ব্যয়, ব্যাংকের এলসি’র ব্যয় তো আছেই। বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানসমুহ এ ব্যয় নির্বাহ করতে সক্ষম হলেও মাঝারি ও ছোট প্রতিষ্ঠানের জন্য এটি অসম্ভব।

সুতরাং শিল্প কারখানার দ্বারা পরিবেশ দূষণ রোধে সরকারের আইন প্রনয়ন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্রশংসনীয় হলেও কার্যকরী ভুমিকার জন্য আর্থিক ও লজিস্টিক সহযোগিতার বিকল্প নেই। সরকার চাইলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় গঠিত তহবিল থেকে শিল্প কারখানার দূষণ রোধে আধুনিক প্রযুক্তি স্থাপনে সহায়তা প্রদান ও দীর্ঘমেয়াদে তা মুনাফা থেকে ফেরত নিতে পারে নামমাত্র সুদে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় দূষণ রোধক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি আমদানি করা ও দেশে এধরণের প্রযুক্তি উৎপাদনে উৎসাহিত করতে হবে। পরিবেশ উন্নয়নে শিল্প কারখানার ভুমিকাকে সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্য করতে প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় বিবরনীতে প্রশাসনিক ব্যয় ও মার্কেটিং ব্যয়ের মতই পরিবেশ সংরক্ষণ ব্যয় নামে আলাদা হিসাব রাখার বিধান করতে হবে, উদ্বর্তপত্রের সম্পত্তি পাশে ‘পরিবেশ সংরক্ষণ সম্পদ’ ও দায় পাশে ‘পরিবেশ সংরক্ষণ দায়’ নামে আলাদা শিরোনামে দুটো খাত রাখা। তাতে করে পরিবেশ দূষণ রোধে শিল্পকারখানা ও সরকারের পদক্ষেপসমুহ দৃশ্যমান ও কার্যকরী হবে। আর পরিবেশ দূষণ রোধের ব্যয় প্রতিষ্ঠানসমুহের জন্য বাধ্যতামুলক হলেও তা বাস্তবায়নে আর্থিক ও লজিস্টিক সহযোগিতা সরকারের জন্য সামাজিক দায়বদ্ধতাই হবে বটে।

মুহাম্মদ আলী আরশাদ চৌধুরী, সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, চ বি। পরিবেশ উন্নয়ন সুচকের নির্ধারক বিষয়ে পিএইচডি গবেষক।