বারবার চোখ ভিজে ওঠে-ববিতা

আমার বয়স যখন ১০-১১, তখন থেকেই এ টি এম ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। বোন ডাকতেন আমাকে। আমরা তখন গেণ্ডারিয়ায় থাকতাম। আমার মা-বাবার সঙ্গে তাঁর দারুণ সম্পর্ক ছিল। প্রায়ই নারায়ণ ঘোষ মিতার সঙ্গে আমাদের বাড়িতে আসতেন। সুচন্দা আপা তাঁকে খুব সমাদর করতেন দেখে আমি ভাবতাম বড় মাপের কেউ হবেন; তাই পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতাম। পরবর্তী সময়ে যখন চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করলাম, তখন বুঝতে পারলাম এ টি এম ভাই কত বড় মাপের অভিনেতা। আমার বিখ্যাত যত ছবি—‘নয়নমনি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ কিংবা ‘লাঠিয়াল’, প্রতিটিতে তিনি ছিলেন। শুধু অভিনেতা হিসেবেই নন, ইউনিটের একজন হয়ে থাকতেন। মনে আছে, তখন আমাদের বেশির ভাগ ছবির শুটিংয়ের লোকেশন ছিল মানিকগঞ্জ। আমজাদ ভাই [পরিচালক আমজাদ হোসেন] ‘ফকির বাড়ি’তেই বেশি শুটিং করতেন। এমনও হয়েছে, এ টি এম ভাইয়ের শুটিং নেই, তবু অন্য শিল্পীদের শুটিং দেখার জন্য বসে থাকতেন। কোথাও কোনো ভুল হলে ধরিয়ে দিতেন। অনেক পরিচালক এ টি এম ভাইকে কাস্ট করতেন শুধু অভিনয়ের জন্য নয়, তিনি ছবিতে থাকলে পাণ্ডুলিপিটা ঘষেমেজে আরো শক্তিশালী করে দেবেন, এই লোভে। আমি নিজে এসব অনেক দেখেছি। এ টি এম ভাইকে পাণ্ডুলিপি দিলে তিনি শুধু নিজের অংশটুকু পড়তেন না, পুরোটাই পড়তেন। অন্যান্য চরিত্রের কোনো অসংগতি থাকলে সঙ্গে সঙ্গে ধরিয়ে দিতেন। কারেকশন করে দিতেন।

আগেরবার যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, আমরা তিন বোন (সুচন্দা, ববিতা, চম্পা) দেখতে গিয়েছিলাম। আমাদের দেখে হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন। কত স্মৃতি যে সেদিন মনে করেছিলেন! আমরা তো এ টি এম ভাইয়ের স্মৃতিশক্তি দেখে অবাক হয়েছিলাম। বড় আপার পরিচালনায় ‘হাজার বছর ধরে’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, আপা ছবি নির্মাণ করবেন শুনে কী যে খুশি হয়েছিলেন! পাণ্ডুলিপি তৈরি থেকে শিল্পী নির্বাচন—কোথায় ছিলেন না তিনি!

এ টি এম ভাই নেই, ভাবতেই বারবার চোখ ভিজে ওঠে। গতকাল সকালবেলায় ভাবির [এ টি এমের স্ত্রী রুনি জামান] সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললাম। কথা বললাম এ টি এম ভাইয়ের মেয়ে কোয়েলের সঙ্গেও। ভাবি বললেন, আগের দিনও নাকি আমাদের কথা বলেছেন। আরো বলেছেন, তাঁর মৃত্যু নাকি পশ্চিম দিকে ফিরেই হবে; তা-ই হয়েছে। ভাবি বললেন, কী কারণে যেন পশ্চিম দিকে মাথা দিয়েই ঘুমাতে দেওয়া হয়েছিল। কথাগুলো বলতে বলতে চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন ভাবি। আমিও কান্না থামাতে পারিনি। একদিন আমাদের সবাইকে না-ফেরার দেশে যেতে হবে। এর চেয়ে বড় কোনো সত্যি নেই। তার পরও কেন যে মেনে নিতে কষ্ট হয়! ওপারে ভালো থাকুন, ভাই আমার। অনেক অনেক দোয়া রইল আপনার জন্য।