বীর কিশোর মুক্তিযোদ্ধা, কৃতি ফুটবলার সাইফুল ইসলামের মৃত্যু বার্ষিকী

১৯৭১ এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক জাতীয় যুব ফুটবল দলের খ্যাতিমান ফুটবলার ও বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক সাইফুল ইসলাম এর মৃত্যুবার্ষিকী ছিলো আজ | জনপ্রিয় এই তরুণ ফুটবলের ১৯৭৭ সালের ১৯ ফেব্রয়ারী সকাল ৯-৩০ টায় চট্টগ্রামের ষোলশহর রেল স্টেশনের সন্নিকটতে চলন্ত ট্রেন এর সাথে ধাক্কা লেগে মর্মান্তিকভাবে আহত হয়ে ঐদিনই দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃস্বাশ তাগ করেন । তাঁর দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার সাথে সাথে হাসপাতালে হাজারো মানুষ ছুটে গিয়ে তাঁদের অনেকের কান্নার শব্ধে এখানকার পরিবেশ ভারী হয়ে যায় | তাঁর জন্য রক্তের প্রয়োজন একথা জানতে পেরে কয়েকশো তরুণ ব্লাড ব্যাংকের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে যায় | হাসপাতালে নেয়ার পরে ইমার্জেন্সিতে তাঁর হুঁশ ফিরে আসার পরে যখন বুঝতে পারলো যে, তাঁর একটি পা আর নেই তখন তিনি চিৎকার করে বললেন, ” আল্লাহ আমার পা আর নেই, আমি আর ফুটবল খেলতে পারবো না, আমি আর বাঁচতে চাই না, আমাকেও নিয়ে যাও” | তখন তাঁর কান্না ও চিৎকারে সব ডাক্তার, নার্স এবং উপস্থিত শত শত মানুষ কান্নায় ভেঙে পরে যে মর্মস্পর্শী দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল তাঁর বর্ণনা এখন ভাষায় করা সম্ভব নয় | তাঁর চিৎকারে হাসপাতালের ভবন যেন কেঁপে উঠেছিল | ডাক্তাররা বুঝাচ্ছিলেন, আর্টিফিশিয়াল পা নিয়ে তুমি স্বাভাবিকভাবে চলতে পারবে, কিন্তু তাঁর ওই একটিই কথা | তাঁর পিতা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ চিকৎসক ডাঃ নুরুল হুদা সাহেব খবর পেয়ে তাঁর কর্মস্থল আর এক হাসপাতাল থেকে দ্রুত ছুটে এসে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে তাঁর ছেলের চোখ, হার্ট বিট, ব্লাড প্রেসার পরীক্ষা করে বেশ আশংকিত হয়ে গেলেন | অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হলো, সবাই অধীরভাবে অপেক্ষায় ছিলেন হাসপাতাল প্রাঙ্গনে | হঠাৎ করে দুপুর বারোটা নাগাদ সবাইকে আকস্মিকভাবে চমকে দিয়ে অবিস্বাশ্য এক খবর এলো ‘সাইফুল আর নেই “| একথা শুনার সাথে সাথে ঐ সময়ে কি দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিলো তা সবাই বুঝতেই পারছেন | তাঁর প্রাণহীন দেহটি শহরের মুরাদপুরস্থ বাড়িতে নেয়ার আগেই সারা শহরে এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে তাঁকে শেষ বারের জন্য দেখতে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসেন | এদের মধ্যে ছিলেন ক্রীড়াবিদ, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, জেলা প্রশাসক, এমপি, ক্লাব-সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, রাজীনীতিক ইত্যাদি | ছুটি হয়ে যায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো কিছু স্কুল ও কলেজ | সে সময় মুরাদপুর এলাকায় নির্মাণাধীন বিশ্বরোডের উপর অনুষ্ঠিত জানাজাটি ছিল স্মরণকালের বৃহত্তম জানাজা | মুরাদপুর মসজিদের পশ্চিমদিকে ঠিক মিম্বরের অতি নিকটের পাকা কবরটিতে এখনো মার্বেল পাথরে খচিত রয়েছে ” কৃতি ফুটবলার মরহুম সাইফুল ইসলাম ” |
স্কুল জীবন থেকেই ফুটবলার ও স্পোর্টসম্যান হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেন | মৃত্যুর আগের মুহূর্তে তিনি ছিলেন প্রথম জাতীয় যুব ফুটবলের রানার্স আপ চট্টগ্রাম একাদশের, চট্টগ্রাম প্রথম বিভাগের অন্যতম সেরা সিজিএমসিএল এর এবং ঢাকার প্রথম বিভাগে উয়ারী ক্লাবের নিয়মিত খেলোয়াড় |
দুর্দান্ত সাহসী তরুণ ও বলে পরিচিত সাইফুল ইসলাম চট্টগ্রামের ফুটবল মাঠের জন্য বিশ্বখ্যাত মেরাডোনার মতো আকর্ষণ সৃষ্টি করেছিলেন দর্শকদের | দেশের যেখানেই খেলতে গিয়েছেন সেখানেই চমক সৃষ্টি করে আসেন | এভাবে তাঁর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে | চট্টগ্রামের এমন কোনো অলি গল্লি ছিলোনা যেখানে তরুণরা সাইফুলের নাম জানতো না | মানুষের বিপদে সাহায্যের জন্য নিজের জীবন এর ঝুঁকি নিতেও এই দুর্দান্ত বলে পরিচিত সাইফুল কুন্ঠাবোধ করতো না | উদাহরণস্বরূপ একটি ঘটনা ছিল,ষোলশহর এলাকায় আগুনের মধ্যে সাহসিকতার মধ্যে একটি পরিবারের ছোট্টু শিশুকে উদ্ধার করা |
মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল :
১৯৭১ এর ৭ ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা আসলো এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তি সংগ্রাম এবং সাইফুল ইসলাম মুরাদপুরে ষোলশহর এবং নাসিরাবাদ এলাকায় ছাত্র-তরুণদের নিয়ে ২৬শে মার্চের কিছুদিন আগে থেকেই ডামি রাইফেল ট্রেনিংয়ে অংশ নেন |
২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার দিন থেকে তাঁর বড়ো ভাই নজরুল ইসলাম হারুন ও তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকদের খাদ্য সরবরাহসহ বিভিন্নভাবে সহায়তা করেন | উল্লেখ্যে যে, অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঘাঁটি ছিল তাঁদের শহরস্থ মুরাদপুরের বাড়ির অত্যন্ত সন্নিকটে, মাত্র ৫০০-৬০০ গজের মধ্যে, ওই রেজিমেন্টের কমান্ড্যান্ট কর্নেল জানজুয়া থাকতেন মাত্র ২৫০-৩৩০ গজের মধ্যে আর ক্যান্টনমেন্ট ৩ মাইল দুরুত্বে| ২৬ মার্চ ওই রেজিমেন্টের বাঙালি সেনারা বঙ্গবন্ধুর ওই রাত্রে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার খবর পেয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং পাকসেনাদের সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং ওই ঘাঁটির আশপাশে নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির বাড়ি গুলিতে বসবাসকারী কর্নেল জানজুয়া ও বেশ কিছু পাকসেনা অফিসারদের গ্রেফতার বা হত্যা করেন | স্বাভাবিক ভাবেই একই সময়ে মুরাদপুর ও ষোলশহর এলাকা গোলাগুলি, আর্তনাদ ও হৈ চৈ এর শব্দে ভারী হয়ে যায় আর এলাকার মুক্তি পাগল মানুষ গুলিও যার যা কিছু আছে তা নিয়ে পাকসেনাদের প্রতিরোধে এগিয়ে আসেন| ঐ দিন সকালে পাকসেনাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধের সময় সাহায্য করতে গিয়ে মুরাদপুরের এক সদ্য বিবাহিত যুবক জানে আলম মাথায় পাকসেনার গুলির আঘাতে আহত হন| লোকজন তাঁকে ধরাধরি করে নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির একটি নির্মাণাধীন বাড়ির বারান্দায় নিয়ে এসে তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন কিন্তু তখন হাসপাতালে নেয়া বা এম্বুলেন্স ডাকার সুযোগ ছিলোনা| এই অবস্থায় নজরুল ইসলাম ও তাঁর ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম তৎক্ষণাৎ অতি নিকটে অবস্থানকারী তাঁদের বাবা ডাঃ নূরুল হুদাকে নিয়ে আসেন এবং শেষ পর্যন্ত জানে আলমকে আর বাচানো যায়নি এবং এক পর্যায়ে চিকিৎসারত ডাঃ হুদার হাতেই শেষ নিঃস্বাশ ত্যাগ করেন| উল্লেখ যে, মাত্র তিন দিন আগে জানে আলম বিবাহ সম্পন্ন করেছিলেন এবং মৃত্যুর সময় তাঁর হাতের মেহেদির রং তখনও মুছে যায় নি| তখনকার সময়ে অনেক গুলি বিয়ের কয়েকদিন আগে থেকে বিয়ে বাড়িতে গানবাজানো হতো উচ্চ শব্দের মাইকে, এটা ছিল একটা রেওয়াজ| মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাত্র তিন দিন আগে অনুষ্ঠিত তাঁর বিয়ে উপলক্ষে সারাদিন বাজানো হয়েছিল সেই সময়কার জনপ্রিয় বাঙালির দেশাত্মবোধক জাগরণের গান গুলি| পরবর্তীতে মুরাদপুরের আমাদের বাড়ির সংলগ্ন রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে শহীদ জানে আলম সড়ক|
৭১ এর মার্চের শেষেরদিকে চট্টগ্রাম শহরের উপর পাকবাহিনীর প্রবল আক্রমণের কারণে নজরুল ইসলাম ও সাইফুল ইসলাম কয়েকদিন পর চলে যান বোয়ালখালী তাঁদের আদি বাড়িতে যেখানে তার পরিবারও ইতিমধ্যে শহর ছেড়ে চলে এসেছিলো। সেখানে বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন।
১৯৭১ এর সেপ্টেম্বর মাসের দিকে বোয়ালখালীর কধুরখীলে মুক্তি প্রিয় মানুষের উপর নিপীড়নকারী সশস্ত্র রাজাকারদের উপর বোমা হামলা করতে গিয়ে দুঃসাহসী কিশোর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম প্রায় ধরাই পড়ে গিয়েছিলেন কিন্তু, ফুটবলার হওয়ায় কোন তিনি দ্রুতগতিতে দৌঁড়ে নিজেকে বাঁচিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে তাঁর এক মাত্র কিশোরসহ যোদ্ধা এখলাস ওই ঘটনায় সাথে সাথে গ্রেপ্তার হয়ে রাজাকার ও পাকসেনাদের নির্মম অত্যাচারে শহীদ হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরে বোয়ালখালীতে ইকবাল পার্কের নাম পরিবর্তন করে শহীদ এখলাস পার্ক রাখা হয়| তাঁর বড় ভাই ও তিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করে ছিলেন।
তাঁর পিতা ডা: নূরুল হুদা চট্টগ্রামে মেডিকেল ছাত্র থাকাকালীন সময় থেকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং পাক-ভারতের স্বাধীনতার পরে জিলা ছাত্রলীগের নেতা ও মেডিকেল স্টুডেন্ট লীগের সভাপতি ছিলেন| মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর পরিকল্পিত বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যার তাঁকে একজন চিকিৎসক হিসেবে হত্যার উদ্দেশ্যে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়| এক বার তাঁর মুরাদপুরের বাড়িতে পাকসেনা ও বিহারি রেফিউজি রাজাকাররা হানা দিলে তিনি দ্রুত পেছন দিয়ে সরে গিয়ে অল্পের জন্য বেঁচে যান | এরপর তিনি বোয়ালখালীতে তাঁর কর্মকান্ড অব্যাহত রাখেন এবং এক পর্যায়ে তিনি সেখানেও টার্গেটে পড়ে যান পাকহানাদার এবং রাজাকারদের। যার কারনে তিনি আবারও বোয়ালখালী থেকেও সরে আসতে হয়েছিল চট্টগ্রাম শহরের চাক্তাই এলাকায় অবস্থান নেওয়ার জন্য। সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগীতা করেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে|
মরহুম সাইফুল ইসলাম ইসলাম স্বাধীনতা পরবর্তীতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং তিনি সকল সভা এবং মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন।
লেখক- ব্যারিষ্টার মনোয়ার হোসেন
(সাইফুল ইসলামের ছোট ভাই)