করোনায় অর্থনীতিতে বিপুল ক্ষতি, উত্তরণে ১০ সুপারিশ

বৈশ্বিক করোনাভাইরাসের কারণে যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে তার ভয়াবহতা শুধু স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তার বিরূপ প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতেও। বিশেষ করে দেশের করোনা শনাক্তের কিছুদিনের মধ্যে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর অচলাবস্থার মধ্যে অনেক শ্রমজীবী মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছিল। পরবর্তীতে তাদের অধিকাংশ কাজে ফিরলেও কিছু মানুষ এখনো কর্মহীন রয়েছে। দেশের করোনার শুরুতেই দেশীয় ও বহুজাতিক বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি ব্যাংক, বীমা, মিল, কারখানার মালিকরা পর্যাপ্ত কাজ না থাকার কারণে ব্যয় সংকোচনের জন্য তাদের কর্মীদের বেতন কর্তন, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমানো এবং এক পর্যায়ে ছাঁটাই করে। ফলে দেশের বিভিন্ন পেশাজীবী বিশেষ করে নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগে ফেলেছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনীতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে ১০ দফা সুপারিশ এবং ৭টি পর্যবেক্ষণ ও কর্মী ছাঁটাইয়ের তিনটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।
১০ দফা সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়ন করতে দেয়া হয়েছে বিশেষ তাগিদ। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, করোনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পোশাক খ্যাত। ১৯৬টি কল-কারখানার ৩৪,১১০ শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে। যেসব শ্রমিক বেকার হয়েছে তাদের যদি দ্রুত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা না যায় বা ত্রাণের আওতায় চাকরিচ্যুতদের আনা না হলে তারা বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে। পাশাপাশি বলা হয়েছে, যেসব শ্রমিক বিদেশ থেকে ফেরত এসেছে তাদের সরকারি উদ্যোগে আবার বিদেশে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়েছে। ৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পুলিশ সদর দপ্তর, স্বরাষ্ট্র, বাণিজ্যসহ একাধিক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার বিষয়টি মানবজমিনকে নিশ্চিত করেছেন।

প্রতিবেদনের প্রথম অংশের (খ) প্রেক্ষিতে বলা হয়েছে যে, করোনায় রপ্তানিজাত শিল্পের মধ্যে পোশাক শিল্প তুলনামূলকহারে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউরোপসহ অন্যান্য রপ্তানিমুখী দেশসমূহে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় অনেক অর্ডার বাতিল হওয়ার পাশাপাশি নতুন করে কোনো অর্ডার আসেনি। ফলে অনেক শিপমেন্ট বাতিল হয়েছে। এর কারণে শ্রমিকদের বেতন-ভাতায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে। করোনাকালীন সময়ে বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংক, বীমা ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফা, সুনাম ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাজারে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে নিয়মনীতি না মেনে কর্মী ছাঁটাই করেছে। প্রতিবেদনে কর্মী ছাঁটাইয়ের তিনটি কারণ দেখানো হয়েছে তা হলো, আন্তর্জাতিক বাজারে অর্ডার কমে যাওয়া এবং পর্যাপ্ত কাঁচামালের অভাব, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফা, সুনাম ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাজারে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে কর্মীদের বেতন কর্তন, বিভিন্ন সুযোগ- সুবিধা কমানো এবং কর্মী ছাঁটাই করেছে। সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটিতে নিম্ন আয়ের মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছে এবং এখনো কিছু মানুষ কর্মহীন রয়েছে।

পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী করোনার প্রভাবে দেশের প্রবাসী কর্মীরা কাজ হারিয়ে অনেকে দেশে ফিরে এসেছে। এদের অনেকে পুনরায় কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে গেলেও করোনা সংক্রমণ অব্যাহত থাকায় নিজেদের পূর্বের কাজে বহাল হতে পারেনি। ফলে অনেক প্রবাসী কর্মহীন অবস্থায় রয়েছে। এজন্য শক্তিশালী কূটনৈতিক তৎপরতা এবং নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টির কর্ম কৌশলের ক্ষেত্র তৈরির প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে যে ১০ দফা সুপারিশ করা হয়েছে তা হলো: কর্মী ছাঁটাই রোধে দেশের সকল কলকারখানা, বেসরকারি ব্যাংক-বীমা কর্পোরেট অফিস-প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনাসহ সরকার কর্তৃক প্রাতিষ্ঠানিক তদারকি ও নজরদারি বাড়াতে হবে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে ছোট এবং মাঝারি অনেক কারখানার কাজের অর্ডার না থাকা ও কাঁচামালের অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটছে। শ্রম মন্ত্রণালয়, কারখানা, অধিদপ্তর, গার্মেন্টস মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের সমন্বয়ে কমিটি গঠনের পরে উক্ত কারখানাগুলোর সমস্যা নিরূপণপূর্বক সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে অবহিত করা। সংকটাপন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মী ছাঁটাই না করে প্রতিষ্ঠানের সকল ব্যয়ের খাত পুন: সমন্বয় করে নিতে পারে অথবা চূড়ান্ত পর্যায়ে ব্যয় সংকোচনের মাধ্যমে কর্মী ছাঁটাই রোধ করা যেতে পারে। যেমন বেতন ২০ হাজার টাকা বা তার ঊর্ধ্বে তাদের ১০ ভাগ বেতন কমিয়ে কর্মী ছাঁটাই বন্ধ করা যেতে পারে। বৈদেশিক শ্রমশক্তি ও পোশাক শিল্প আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। করোনা পরবর্তী বিশ্ববাজারে এ দুই খাতকেই শক্ত অবস্থানে রাখতে শক্তিশালী কূটনৈতিক তৎপরতা, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক জোরদার এবং মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও জনশক্তি রপ্তানির নতুন নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি করার কর্ম কৌশল সরকারকে তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি পূর্বে বিদেশে কর্মরত ছিল এমন কর্মীদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে স্বল্প খরচে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

সুপারিশে বলা হয়েছে যে, পোশাক শিল্পকে পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমইএ সহ সকল রপ্তানি পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কারখানার মালিক পক্ষের সংগঠন এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে নতুন ক্রয়াদেশ পাওয়ার পদক্ষেপ নেয়া। সরকার ঘোষিত শিল্প ঋণের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ মালিকগণ যাতে নিজ স্বার্থে ব্যবহার না করে যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রান্তিক নিম্ন পেশার জনগোষ্ঠী যারা করোনার প্রভাবে কর্মহীন হয়েছে তাদের সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনা অথবা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ত্রাণের আওতায় আনা।
সুপারিশে আরো বলা হয়েছে, করোনার প্রাদুর্ভাবে ছাঁটাইকৃত কর্মহীন শ্রমিক যারা গ্রামে অবস্থান করছে তাদের স্থানীয় কৃষি প্রশাসনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

করোনায় মহামারি চলমান থাকায় কোনো শ্রমিক সংগঠন, এনজিও এর নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীরা যাতে শ্রমিকদের বা ছাঁটাইকৃত কর্মীদের উস্কানি দিয়ে দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল না করতে পারে সেদিকে গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রাখা।

এ ছাড়াও ব্যাংক-বীমা, বড় বড় কর্পোরেট অফিসসহ অন্যান্য বে-সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে করোনাকালে যারা চাকরি হারিয়েছেন তাদের ক্রমান্বয়ে পূর্বের প্রতিষ্ঠানে স্বপদ ফিরে পেতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।