পারিবারিক হিসেবের হালখাতা

জি এম সামদানী
হিসেব মেলানো এমনিতেও সহজ নয়। আর সেটা যদি হয় পারিবারিক হিসেব তা হলে তো কথাই নেই। পারিবারিক হিসেবের হালখাতা মেলানো সবচেয়ে কঠিন কাজ। বাঙ্গালী সমাজের ঐতিহ্য হলো একান্নবতী পরিবার। শিক্ষার প্রসার, নগরায়ন, শিল্পায়ন,নারীর ক্ষমতায়ন ও বৈদেশিক রেমিটেন্সের প্রবল স্রোতে যৌথ পরিবার ভেঙ্গে গড়ে উঠেছে একক পরিবার, যা পারিবারিক হিসেবকে আরো জটিল করে তুলেছে। আয়ের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না থাকায় এবং বহুমুখীকরণের ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আয় বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে, যা পারিবারিক ভাগ বাটোয়ারায় সমস্যা তৈরি করছে। আমাদের সমাজে সাধারণত পারিবারিক হিসেবের হালখাতা খোলা হয় এমন এক সময় যখন পরিবারে অনেক নতুন সদস্যের আগমন ঘটে। ভিটে মাটির অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি, সম্পদের প্রতি অতি মোহ, স্ত্রী-সন্তানের প্রতি প্রবল টান এই হিসেবকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের অবদানের সঠিক মূল্যায়ণ প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ভাগের বরাতে কেউ কারো অবদান মেনে নিতে মোটেও রাজি নয়। এসব কারণে পারিবারিক হিসেব মেলানো দিনদিন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। বিচারের বাণী এখানে অনেকটাই অসহায়। তাই এ নিয়ে গ্রামীণ জীবনের প্রায় প্রতিটি পরিবারে চলছে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও মনো-মালিন্য। সবচেয়ে আপনজনদের মধ্যে এ বিবাদ পারিবারিক ও সামাজিক সংহতি ও সম্প্রীতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। সমাজ বিবর্তনের ধারা একে আরও উসকে দিচ্ছে। সমাজের সবচেয়ে আদি ও ক্ষুদ্রতম সংগঠন পরিবারকে কেন্দ্র করেই সমাজ বর্তমান পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। পারিবারিক ভিত দুর্বল হওয়া মানে সমাজের ঝলম ভেঙ্গে পড়া। পারিবারিক ভাগ-বাটোয়ারাকে কেন্দ্র করেই মূলত পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিবাদ দানা বাঁধছে। সামাজিক চুক্তি মতবাদের প্রবক্তা জন লক ও জ্যাঁ জ্যাক রুশো তাই বলেছেন, প্রকৃতির রাজ্যে অশান্তির জন্ম দেয় ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা ও প্রাকৃতিক আইনের সঠিক ব্যাখ্যার অভাব। পরিবারের রথযাত্রা শুরু হয় মা-বাবাকে ঘিরে। তারা জীবনের সবকিছু অকাতরে বিলিয়ে দেয় সন্তানের জন্য। তাদের অবদানের পাশাপাশি ধীরে ধীরে অবদান রাখতে শুরু করে পরিবারের বড় সন্তান। ক্রমান্বয়ে আসে ছোটদের পালা। পরিবারের সকলের মেধা যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা এক নয় বলে অবদানে তারতম্য হয়। তবে এতে কোনো সমস্যা হয় না যেহেতু সবাই পরস্পরকে সবচেয়ে আপন ভাবে। সত্যিকার অর্থেও মা-বাবা ও ভাই-বোনের চেয়ে আপন পৃথিবীতে কে আর হতে পারে? কিন্তু যখন হিসেবের হালখাতা খোলা হয় তখন প্রায় সবারই নিজস্ব পরিবার ও সন্তান-সন্ততি থাকে। মা-বাবা ও ভাই-বোনের চেয়ে বেশি আপন হয়ে যায় তারা। নিজের স্ত্রী-সন্তানের স্বার্থ সবাই এত বড় করে দেখে যে, মা-বাবা ভাই-বোন সেখানে গৌণ হয়ে যায়। পরিবারে প্রত্যেক সদস্য অবদান রাখে মা-বাবা ভাই-বোনকে সবচেয়ে আপনজন ভেবে, কিন্তু ভাগাভাগির সময় যেহেতু তারা পর হয়ে যায় তাই সমস্যা জটিল হয়ে ওঠে। কেউ কারো অবদানকে মেনে নিতে পারে না। সবাই নিজের অবদানকে বড় করে দেখে বড় ভাগটা নিতে চায়। আর এটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ Everybody is blind to his own faults. সমস্যা কেবল তাদের যারা এর উর্ধ্বে। ষোল আনা সম্পদকে টেনে সতের আনা করা সম্ভব নয় কিন্তু সবাই চায় ষোল আনার চেয়ে একটু বেশি, এটাই মূল সদস্যা। পারিবারিক ও সামাজিক শাসনের ক্রমহ্রাসমান দুর্বলতা এ অবস্থাকে দিনদিন জটিল করে তুলছে। মা-বাবার আদেশ অমান্য করার সাহস পেত না আমাদের বাপ-চাচা ও মা-খালারা। বাপ-চাচার শাসন অমান্য করত না আমাদের মা-চাচীরা। মা-বাবার আদেশ মান্য করার মাত্রা কমে গেছে আমাদের মধ্যে। এক্ষেত্রে আমাদের চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে আছে আমাদের সন্তানরা, অর্থাৎ তারা আজ আর বড়দের মানতেই রাজি নয়। এ ধারা সমান তালে অব্যাহত আছে সামাজিক শাসনের বেলায়ও। অন্যের সন্তানকে শাসন করার দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে। পরিবারের মতো সমাজেও শাসন মানার প্রবণতা কমছে। সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সিংহভাগই সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে সামাজিক বিচার সালিশ করছে। তাই সেবা আজ সার্ভিসে পরিণত হয়েছে, যা পারিবারিক সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলছে। ঘটক পাখি ভাইয়ের উত্তরসূরী তৈরি হয়েছে গ্রামেও। গেল তিন দশকে আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন হয়েছে, বিশেষ করে বিদেশি রেমিটেন্সের সুবাদে। প্রতি মাসে গড়ে প্রায় দেড় বিলিয়ন রেমিটেন্স আসছে কেবল বৈধ উপায়েই। তাই তিন দশক আগে যেখানে গ্রামের শতকরা প্রায় পঞ্চাশ ভাগ বাড়ি ছিল শনের, পঁয়তাল্লিশ ভাগ টিনের এবং পাঁচ ভাগ পাকা ও সেমি পাকা, এখন সেখানে প্রায় আশি ভাগ বাড়ি-ঘর পাকা ও সেমি পাকা, বাকী বাড়ি-ঘর টিনের। শনের ঘর নেই বললেই চলে। কিছুদিন পর হয়ত শনের ঘর দেখতে জাদুঘরে যেতে হবে। কিন্তু নেই ভাইয়ে ভাইয়ে, ভাইয়ে-বোনে ও বাপ-চাচায় মিল। পরিবারে কেউ কারো কথা শুনতে ও মানতে রাজি নয়। এমনকি মা-বাবাও এ নিয়ে আছে বড় বিপদে। বৃদ্ধ বয়সে টানা হেঁচড়ায় তাদের দিন কাটাতে হচ্ছে। কারো পক্ষ না নিলেও সবাই তাদের প্রতিপক্ষ ভাবে। তাদের ভাগের জমিটুকু দখল নেয়ার জন্য সবার মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে। কাউকে দিয়ে গেলে তো আরও বিপদ। বৃদ্ধদের জন্য যে ভারতবর্ষ একদিন ছিল স্বর্গরাজ্য সে বৃদ্ধ মা-বাবার নিরাপত্তার জন্য আজ আমাদের আইন করতে হচ্ছে। এর চেয়ে অপমানজনক কি আর হতে পারে? আমরা আজ ভুলে গেছি একদিন আমাদেরও বৃদ্ধ হতে হবে! ভিটে মাটির মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের ফেলে যাওয়া পরিত্যক্ত প্রস্রাব পায়খানা, নালা-নর্দমা নিয়ে টানাটানি করছি। এ নিয়ে বিচার শালিসী ও মামলা মোকদ্দমার রমরমা ব্যবসা জমে ওঠেছে। এসব নিয়ে চায়ের দোকানে ঝড় তুলছে সুবিধাবাদী শ্রেণি, যাদের সাথে রয়েছে থানা-আদালতের সখ্যতা। তাই পারিবারিক ভাগ-বাটোয়ারায় পরোক্ষভাবে ভাগ বসাচ্ছে বেওয়ারিশরাও। পূঁজিবাদী বিশ্বে যেখানে সবাই পূঁজি নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে, সেখানে তারা খালি হাতে কেবলই জনগণকে সেবা দিয়ে যাবে এটা কি ভাবা যায়? যেহেতু পরিবার ও সমাজে আজ কেউ কাউকে মানতে চাচ্ছে না, তাই বিচার শালিসী বেড়েই চলেছে। বিচারিক আদালতে মামলার জট কমাতে সরকার সামাজিক বিচার-মীমাংসাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। আর এটাকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করছে গ্রাম্য বিচারকরা। গ্রাম্য ডাক্তারের মতো তারাও থানা আদালতে মামলা রেফার করছে। তাই পারিবারিক বন্টন নিয়ে প্রায় প্রতিটি পরিবারেই চিতার আগুন জ্বলছে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা বিশ্ব একই সূত্রে গাঁথা। অবিচার, অনিয়ম এক জায়গায় দেখা দিলে দাবানলের মতো তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তাই প্রতিটি পরিবারে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হলে পুরো সমাজ রাতারাতি বদলে যেতে বাধ্য। তবে প্রধান নিয়ামক যেহেতু রাষ্ট্র, তাই তাকেই প্রথম ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিতে হবে। পারিবারিক হিসেবের হালখাতা মেলানো সম্ভব হলে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় হালখাতা মেলানোও সম্ভব হবে। আর এজন্য দরকার ন্যায় বিচার। তাই দার্শনিক প্লেটো তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘‘The Republic’’ এর মুখবন্ধন করেছেন ‘‘The Justice’’ এর মাধ্যমে। যেখানে তিনি ন্যায়দেহ ও ন্যায় রাষ্ট্রের মাধ্যমে জাস্টিসকে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। দেহে ন্যায় বিচার না থাকলে রাষ্ট্রে ন্যায় বিচার থাকবে কোথায় থেকে? কারণ দেহ রাষ্ট্রেরই ক্ষুদ্রতর রূপ। তাই পারিবারিক হিসেবের হালখাতা মেলাতে হলে ব্যক্তিদেহ এবং রাষ্ট্র দেহে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নিঃসন্দেহে তা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এ জন্য দরকার সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। তাই পারিবারিক ও সামাজিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা ছাড়া পারিবারিক হালখাতা মেলানো কঠিন।