প্রতিশ্রুতি, প্রতিজ্ঞা বা ওয়াদা পালন করা মানব জীবনের একটি মহত্তম গুণ। সংসার জীবনে কঠিনতম কাজগুলোর মধ্যে প্রতিশ্রুতি রক্ষা, ওয়াদা পালন করা কঠিনতম সর্বোত্কৃষ্ট কাজ। সংসার, সমাজ জীবনে যারা এই গুণের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন,তারাই মানুষের কাছে আদরণীয়,সম্মানিত ব্যক্তি। মনে রাখতে হবে অপরের সাথে ওয়াদা করা, প্রতিশ্রুতি দেয়া, শপথ সংকল্প বা বিভিন্ন ধরনের চুক্তি এবং অঙ্গীকার পালন করা ঈমানের একটি অঙ্গ। যে কোন ধর্মে ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি পালনের গুরুত্ব অপরিসীম। দুনিয়ার সবাই ওয়াদা পালনকারী ব্যাক্তিকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে থাকে। তাকে সম্মান করে এবং মান্যও করে। ইসলামেও এর ব্যাতিক্রম নয়। ইসলামে ওয়াদার গুরুত্ব অত্যন্ত বেশী। ওয়াদা ভঙ্গকারীকে ইসলামে ভৎসনা করে, এমনকি ওয়াদা ভঙ্গকারীকে মুনাফিকের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি হলো: সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পরস্পরের সাথে যে মৌখিক বা লিখিত চুক্তি বা অঙ্গীকার করা। ওয়াদা একটি আরবী শব্দ, “আ’হদ” শব্দ হতে নির্গত। আভিধানিক অর্থ হচ্ছে: অঙ্গীকার, চুক্তি, প্রতিশ্রুতি, ওয়াদা, প্রতিজ্ঞা ইত্যাদি। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা জঘন্য অপরাধ। এ কথা জেনেশুনেও আমরা সজ্ঞানে অহরহ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে চলেছি। প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করা যেন আজকাল আমাদের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইসলামী পরিভাষায়: কোনো লোকের সঙ্গে অপর কোনো ব্যক্তি অঙ্গীকার করলে বা কাউকে কোনো কথা দিলে তা পালন করার নাম ওয়াদা। জীবনে প্রতিনিয়ত চলার পথে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকি পেয়েও থাকি। ইসলাম এসব প্রতিশ্রুতি পালন করার জোরালো তাকিদ করেছে। আল্লাহ ওয়াদা পালনকারীকে ভালোবাসেন। প্রতিশ্রুতি পালন করা আল্লাহর একটা অন্যতম গুন। আল্লাহ নিজে প্রতিশ্রুতি পালন সম্পর্কে আল কোরআনে ইরশাদ করেন : স্মরণ রাখিও যে, আল্লাহরই সত্বাধীন রহিয়াছে যাহা কিছু আসমান সমূহে এবং যমীনে আছে। স্মরণ রাখিও যে, আল্লাহর ওয়াদা সত্য, কিন্তু অধিকাংশ লোক বিশ্বাস করে না। (সূরা ইউনুস-৫৫) আল কোরআনের অন্য এক জায়গায় আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন : ও মুমিনেরা তোমরা কেন বল যা তোমরা তা করনা? আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃন্য সে ব্যাক্তি, যে নিজে যা বলে কিন্তু সে তা করেনা। (সুরা সফ-২/৩) প্রতিশ্রুতি পূরণ করার ক্ষমতা থাকা অবস্থায় এবং প্রতিশ্রুতি পালন করতে ধর্মীয় কোনো বাধা না থাকলে যেকোনো মূল্যে তা পূরণ করা ওয়াজিব। বিশেষ কোনো যৌক্তিক কারণে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়লে, যাকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তাকে বিনয়ের সাথে নিজের অপারগতা সম্পর্কে অবহিত করে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে।
ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি পালন ও আমানতদারী মানুষের কল্যাণমুখী গুণগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ। তা সত্যবাদিতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আল কুরআনে মহান রাব্বুল আলামীন প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তির পরিচয় ও গুণাবলীর কথা উল্লেখ করে ইরশাদ করেন: এবং যারা নিজেদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। (সূরা মুমিনুন-৮) নেক বান্দা ও নেক আমলের আলোচনা প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : এবং প্রতিশ্রুতি দিলে তারা পূর্ণ করে। (সূরা বাকারা-১৭৭) ইসলামে প্রতিশ্রুতি পালন বাধ্যতামূলক। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন : এবং তোমরা প্রতিশ্রুতি পালন করবে, প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে তোমাদের নিকট কৈফিয়ত তলব করা হবে। (সূরা বনি ইসরাইল-৩৪)
প্রতিশ্রুতি পালনের মর্যাদা: আল্লাহ তা’আলা সমস্ত মানবজাতিকে সৃষ্টি করে এ দুনিয়ার জমিনে পাঠিয়েছেন তাঁরই খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন: এবং (তোমরা সকলেই সেই সময়ের কথা স্বরণ কর) যখন তোমার প্রভূ (আল্লাহ তা’আলা) ফেরেশতাগণকে বললেন : নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে (আমার) খলিফা (বা প্রতিনিধি) সৃষ্টি করবো। (সূরা বাকারা-৩০) আর সেই প্রতিশ্রুতি মোতাবেক তিনি সর্বপ্রথম মানবজাতির পিতা হযরত আদম আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সৃষ্টি করেন। অতঃপর আদম আলাইহি ওয়াসাল্লামের পৃষ্ঠদেশ থেকে সমস্ত মানবজাতির রূহ সৃষ্টি করে একটি সংরক্ষিত স্থানে (রূহ জগতে) একত্রে রেখে সকলের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন, দুনিয়াতে এসে তাঁর গোলাম বা বান্দাহ হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করার। সেদিন আমরা সকলেই সে বিষয়ে আল্লাহর নিকট অঙ্গীকারও করেছি। আর সে ব্যাপারেই আল্লাহ সকলকে স্মরণ করে দিয়ে বলছেন: হে মানবজাতি! তোমরা সেই সময়ের কথা স্মরণ কর) যখন তোমার প্রতিপালক বানী আদমের পৃষ্ঠদেশ হতে তাদের বংশধরকে বের করলেন এবং তাদেরকেই (অর্থাৎ সমস্ত মানব রূহকেই) তাদের (পরস্পরকে পরস্পরের) উপর-সাক্ষী করে জিজ্ঞেস করলেন; আমি কী তোমাদের প্রতিপালক নই? তারা (সমস্ত রূহই) সমস্বরে উত্তর দিলো; হ্যাঁ! আমরা (এ ব্যাপারে পরস্পরের) সাক্ষী থাকলাম। (আর এই স্বীকৃতি ও সাক্ষী বানানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে) যাতে তোমরা কিয়ামতের দিন (দুনিয়ার কৃতকর্মের হিসাব দেয়ার সময়) বলতে না পারো যে, আমরা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অনবহিত ছিলাম। (সূরা আ’রাফ-১৭২)
এ ছাড়া দুনিয়াতে এসেও আল্লাহর খলিফা হিসেবে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করছি। কিন্তু ব্যক্তি স্বার্থে অন্ধ হয়ে সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে যেমনিভাবে আমাদের অপর একজন ভাইকে ক্ষতিগ্রস্থ করছি, তেমনিভাবে নিজেও ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে অকল্যাণ ভোগ করছি। এমন কী আমরা দুনিয়ায় আসার পূর্বে আমাদের পরম সৃষ্টিকর্তার কাছে যে অঙ্গীকার করে দুনিয়ায় এসেছি, সেই কথা ভুলে গিয়ে আল্লাহর বিরুদ্ধেও কাজ করছি। ফলে আমরা মানব জাতি পরস্পর পরস্পরের দ্বারা কল্যাণ লাভের পরিবর্তে সর্বদাই অকল্যাণ ভোগ করছি। অথচ আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন: যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুণ রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন, তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তারা লানতের অধিকারী এবং তাদের জন্যে আছে আখেরাতে মন্দ আবাস। (সূরা রা’দ-২৫)
প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা মুনাফিকের স্বভাব: হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন : মুনাফিকের আলামত তিনটি :
১. তারা অধিক পরিমাণে মিথ্যা কথা বলে,
২. প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না
৩. এবং তাদের কাছে আমানত হিসেবে কোনো জিনিস গচ্ছিত রাখলে তা খেয়ানত করে। (বুখারী ও মুসলিম)
তারা মুখে এক অন্তরে আরেক। নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, আবার ঘুষও খায়, দুর্নীতিও করে, অন্যের হক আদায় করে না। মুখে দাবি করে মুসলমান, কাজে দেখায় মুনাফেকি। মুমিন বান্দা যাকে-তাকে যখন-তখন প্রতিশ্রুতি দেন না, যদি দেন তাহলে যেকোনো মূল্যে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন। ওয়াদা পালন করা আখলাকে হামীদা বা প্রশংসনীয় আচরণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, এটি ঈমানের একটি অঙ্গ। ওয়াদা পালন করা মানে কথা দিয়ে কথা রাখা, যে লোক ওয়াদা পালন করে তাকে সবাই বিশ্বাস করে, ভালোবাসে, ওয়াদা পালন করলে আল্লাহ খুশি হন।
প্রতিশ্রুতি বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে: যেমন স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রদত্ত নির্ধারিত মোহরানার প্রতিশ্রুতি, পিতা-মাতা সন্তানের সাথে, ভাই ভাইয়ের সাথে, বোন বোনের সাথে, আত্মীয় আত্মীয়ের সাথে বিভিন্ন ধরনের প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হওয়া। সমাজে চলতে গিয়ে, অফিসে-আদালতে কাজকর্ম করতে গিয়ে লিখিত বা অলিখিত নানা রকম ওয়াদা বা অঙ্গীকার করতে হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেনদেন চলে বিশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে। কোনো দেশের ভিসা গ্রহণ করা হলে সে দেশের আইনকানুন মানার জন্য প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। কোনো দেশে বসবাসকারীও কার্যত সে দেশের রাষ্ট্রীয় আইনকানুন মেনে চলার প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ। নির্বাচনের সময় জয়ী হওয়ার জন্য নেতারা জনগণকে ভূরিভূরি ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। দেশপ্রেমিক সভা-সমিতিতে নানান প্রতিশ্রুতি দেন। এভাবে জীবনের বহু ক্ষেত্রে মানুষ মানুষের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা পরবর্তীকালে পালন করার কথা আমরা খুব কমই ভাবি। এসব প্রতিশ্রুতি পালন বা রক্ষা করা অপরিহার্য কর্তব্য। প্রতিশ্রুতি পালন না করলে মনের স্বচ্ছতা কমে যায়। সব চেষ্টা ও মেহনত ব্যর্থ হয়। ঈমান নষ্ট হয়। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি দেখা দেয়। তা ছাড়া জেনেশুনে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা সম্পূর্ণ শিষ্টাচারের পরিপন্থী ও মিথ্যাচার। ইসলামে যা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ বা হারাম।
রাসূলে করীম (সা) বলেছেন : যে আমানত প্রত্যর্পণ করে না, তার ঈমান নেই। আর যে ওয়াদা রক্ষা করে না তার কোনো ধর্মই নেই। তাই যেসব প্রতিশ্রুতি পালন করা যাবে না সে সব মিথ্যা প্রতিশ্রুতি থেকে বিরত থাকা এবং কথায় কথায় প্রতিশ্রুতি দেয়ার ফ্যাশন থেকে নিজেকে রক্ষা করা উচিত। ওয়াদা ভঙ্গ করা যে কত বড় অপরাধ তা যদি আমরা জানতাম তাহলে আমরা কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করতাম না। আসুন আমরা ওয়াদা পালনের প্রতিজ্ঞা করি। এই ওয়াদা পালনের মাধমে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করি। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দান করুন। আমীন!