গল্প: ঘর

-শারমিন সুলতানা রাশা
এ দেশের বেশি ভাগ নারীর এক বিশেষ দুর্বলতা তার কোন ঘর নেই। অন্যের ঘরকে নিজের মনে করেই একটা জীবন পার করতে হয়। আর তার জন্য কম সংগ্রাম করতে হয় না। আর সবাই সে সংগ্রামে জয়ীও হয় না। যারা জয়ী হয় না তাদের দলের একজন কুহু।
আজ কুহুর বাবা চলে গেছেন। যাওয়ার আগে সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে। এবার তাই বুঝে নেয়ার পালা। কুহুর ভাইরা কুহুর অংশ কুহুকে বুঝিয়ে দিলেন। কুহু ভাবছে এর আবশ্যকতা আর কি আছে! যে সময়ে একটা আশ্রয়ের দরকার ছিল কারও কাছে সে সম্মানের আশ্রয় টুকু পায় নি। নিজেকেই বেছে নিতে হয়েছিল অসম্মানের এক জীবন। সে জীবনে অভ্যস্থ হওয়ার পর এ নাম মাত্র উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি গ্রহণ করার অর্থ নিজেকেই অপমান করা নয়? বাবা বেঁচে থাকলে কুহু এই সম্পত্তি তার মুখের উপর অস্বীকার করতো। কিন্তু এখন স্বীকার-অস্বীকারে কিছু এসে যায় না। কারণ, তার অন্যান্য রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়রা তাতে বিন্দুমাত্র আক্ষেপ জানাবে না।
ছাদের সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে কুহু ভাবছে কত বার এই বাবার কোলে উঠেছে। বাবার আদরে ঘুমিয়ে পড়েছে কত বার। বড় হতে হতে এমন পর কি করে হল সব? বিয়ের পর থেকেই এ বাড়ির দরজা কিছু সময়ের অবসর ব্যতীত কুহুর জন্য বন্ধ হলো। কিছু দিন বেশি কাটালেই ধরে নিত শ্বশুর বাড়িতে কোন ঝামেলা হয়েছে। ঠিকই ধরতো। ঝামেলা হবেই বা না কেন? শিক্ষিত বউ আর স্বল্প শিক্ষিত শ্বাশুড়ির ব্যাটে-বলে জমবে কি করে? মানিয়ে নেয়া যায় একদিন, দুদিন। দিনের পর দিন নয়। প্রেমের বিয়েতে এ এক সমস্যা। কোন ঝামেলা হলে বাবা-মার কাছে আশ্রয় নিতে দ্বিধা জাগে।
বাবার নিথর দেহ বার করছিল দুই জোড়া কাঁধ। এরই মধ্যে বাধ সাধলো কুহু।
‘দাঁড়াও! কেউ লাশ নেবে না। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে বলো! নামাও!’
এ রকম কান্ড কেউ দেখে নি আগে। শোকে মেয়েটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে বোধ হয়। সবাই ফিসফিস করছে।
লাশটাকে নামিয়ে আরেক বার কুহুকে মুখ দেখান হলো।
কুহু সবাইকে শুনিয়ে বললো, ‘বাবা! আমার ঘর কোথায়? আমি কোথায় থাকবো???’
কুহুর প্রশ্ন সবাই শুনলো। কেবল উত্তরটা কুহু একা শুনলো- ‘ মা রে! আমাদের কারও কোন ঘর নেই। সবাই অন্যের ঘরে একটা জীবন পার করি! তুইও পারবি।’
কুহু হাসলো। আসলেই! কারও কোন ঘর নেই! আছে কি?
-শারমিন সুলতানা রাশা
মঞ্চাভিনেত্রী, নির্দেশক, গল্পকার ও নাট্যকার