মানসিক চাপে শিশুরা

শৈশব মানেই হচ্ছে দুরন্তপনা। হেসে খেলে বেড়ানো। মন যা চায় তা করা। যেখানে থাকে না কোনো ভয়, থাকে না কোনো চিন্তা। কিন্তু করোনার প্রভাব শিশুদের কোমল মনেও ভয়ের সঞ্চার করছে। মানসিক এক চাপে তারা ভুগছে। ঘরে বন্দি থাকতে থাকতে তাদের মনে করোনা ভয়। এতে করে আচরণগত পরিবর্তন এসেছে শিশুর মধ্যে।
দশ বছর বয়সের আপন। বেশ কিছু দিন ধরে অস্বাভাবিক আচরণ করছে। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া, লেখাপড়া করছে না। তার শুধু একটাই চিন্তা বাবা-মা মরে গেলে সে কীভাবে একা থাকবে। আপনের মা নাসরীন আফরোজ ফার্মগেটের খামার বাড়িতে চাকরি করেন। তার বাবা চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। প্রতিষ্ঠানের কর্মস্থল ত্যাগ না করার নির্দেশ থাকায় গত তিন মাসের বেশি সময় ঢাকায় আসতে পারছেন না। এদিকে আপনের মাকেও নিয়মিত অফিস করতে হচ্ছে। নাসরীন আফরোজ বলেন- আমাকে অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে দেখলেই আপন চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করে। বলতে থাকে আব্বু ঢাকায় নাই আর তুমি মরে গেলে আমি কীভাবে থাকবো। খাওয়া-দাওয়া, লেখাপড়া কিছুতেই মন নেই তার। আমি যতক্ষণ অফিসে থাকি প্রতি দশ মিনিটে একবার করে ফোন দেয়। আমি যতই বোঝানোর চেষ্টা করি কাজের সময় ফোন দিও না সে বুঝতে চায় না। অফিস থেকে ফিরে দেখি যে খাবার দিয়ে গিয়েছিলাম সেটাও ঠিকমতো খায়নি। অথচ আপন আগে কখনও এমন করতো না। ওর জন্মের আগে থেকেই আমি চাকরি করি। করোনা আমাদের পুরো জীবনটাকে পাল্টে দিয়েছে। একদিন হয়তো করোনা চলে যাবে। কিন্তু আপনের মধ্যে যে ভীতি তৈরি হয়েছে এটা কীভাবে দূর করবো- সেটাই এখন চিন্তার বিষয়। এদিকে পাঁচ বছরের আমিনাও জানে ঘরের বাইরে থাকে করোনাভাইরাস। আমিনার বাবা মাসুদ জানান, আমিনার এখন সব প্রশ্নই থাকে করোনাভাইরাসকে ঘিরে। বাবা করোনাভাইরাস কবে চলে যাবে? আমরা আবার কবে টগি ওয়ার্ল্ডে যাবো? করোনাভাইরাস হলে কি মানুষ মরে যায়? মরে গেলে মানুষ কোথায় যায়? স্কুলে কি করোনাভাইরাস আছে? আমি আর কোনোদিন স্কুলে যাবো না। এমন কত শত প্রশ্ন তার মনে। আমি যতই অন্য কথা বলি সে ঘুরে ফিরে করোনা নিয়েই সব প্রশ্ন করে। এমন কি আমি অফিস থেকে বাসায় ফিরে ফ্রেশ হওয়ার পরও সে আমার কাছে আসতে চায় না। বলে, আব্বু আমাকে ধরো না বাইরে করোনাভাইরাস। এখন আর আগের মতো আমিনার চঞ্চলতা নেই। গত তিন মাসে চার দেয়ালে বন্দি থেকে অনেকটাই বদলে গেছে আমিনা। আমি বাবা হিসেবে চাই না তার এই পরিবর্তন। আমি চাই আমার শিশু স্বাভাবিক ও সুস্থভাবে দুরন্ত শৈশব পার করুক। গত ২৮শে মে করোনায় আক্রান্ত হন ব্যবসায়ী ফাহাদ কামাল। তিনি ধানমণ্ডিতে থাকেন। তার চার বছর বয়সী একমাত্র মেয়ে এলিসার সুরক্ষার জন্য তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় তার নানা বাড়ি। এখনো এলিসা তার নানা বাড়িতে আছে। ফাহাদ কামাল এখন সুস্থ হলেও মেয়েকে তার কাছে আনার সাহস পাচ্ছেন না। ফাহাদ কামাল বলেন, আমার করোনা রিপোর্ট পজেটিভ এলে এলিসাকে তার নানা বাড়িতে পাঠিয়ে দেই। কিন্তু সে কিছুতেই যেতে চাইছিলো না। সে কখনো আমাকে ছাড়া এতদিন থাকেনি। প্রতিদিন ভিডিও কলে কথা হয় এলিসার সঙ্গে। আমার কাছে আসার জন্য কান্নাকাটি করে। আবার বলে আব্বু তোমার ওখানে কি করোনা ভাইরাস আছে। সে আবার করোনাভাইরাসকে ভয়ও পায়। আরিফ মাহামুদ ও জেসমিন জাহান দুজনেই পেশায় চিকিৎসক। তাদের দুই সন্তান জুনাইরা এবং জাহিন। দুইজনই স্কুলে পড়ে। ডা. আরিফ জানান, জুনাইরা ও জাহিন দুজনেই আমাদের নিয়ে ভয়ে থাকে। তারা শুনেছে অনেক চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত এবং মারা গেছে। বাবা-মা কেন হাসপাতালে যাও? কেন চাকরি ছেড়ে দেও না? এসব প্রশ্ন তাদের। মনোরোগ বিশেজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামালের মতে, করোনা নিয়ে শিশুরা যে ভয় পাচ্ছে এটা রিয়েল ভয় । কারণ এর আগে শিশুরা কোনো রোগ নিয়ে বা মৃত্যু নিয়ে এত আলোচনা শুনেনি। এখন আমাদের আলোচনার বিষয় হচ্ছে প্রতিদিন কতজন করোনায় আক্রান্ত আর কতজনের মৃত্যু হয়েছে। এতে করে শিশুরা আতঙ্কিত হয়ে যাচ্ছে। এবং যাদের বাবা-মায়েরা করোনার ফ্রন্ট লাইনে কাজ করছে সেইসব সন্তানদের মেন্টাল ব্রেক ডাউন হচ্ছে। আমাদের এখন উচিত হবে শিশুদের সামনে করোনা নিয়ে আলোচনা না করা। তাদের সামনে টেলিভিশনের খবর না দেখা। করোনাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন না করে আমাদের ইতিবাচক ভাবে উপস্থাপন করতে হবে। করোনা হলে মানুষ শুধু মরে যায় না দ্রুত সুস্থ হয়ে হয়- এটা শিশুদের বোঝাতে হবে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে ভূমিকা রাখতে হবে। তারা শুধু নেতিবাচক খবর পরিবেশন না করে করোনায় সুস্থতার হার অনেক বেশি। সেটা যেন ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। আমরা যদি এখন শিশুদের সামাজিক আতঙ্ক, পারিবারিক আতঙ্ক দূর করতে না পারি তাহলে ভবিষ্যতে তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে।