চন্দ্রঘোনায় স্বামী সন্তান হারা অন্ধ বৃদ্ধার ঘরবসতি

নজরুল ইসলাম লাভলু, কাপ্তাই:
সত্তরোর্ধ্ব স্বামী, সন্তান হারা অন্ধ লক্ষী রানী দে। কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা খ্রীস্টিয়ান হাসপাতালের বারান্দায় এখন তার ঘরবসতি। কি শীত, কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা কিংবা উৎসব পার্বন কখন যে চলে যায়, তার জীবনে এসবের কোন কিছুই আসে যায় না। প্রতিদিন দু’মুঠো দুটো ভাত তরকারি পেলেই তার দিন চলে যায়। লক্ষী রানী দে’র জীবনে গত ২৮ বছরেও সুখের দেখা মিলেনি ।
চন্দ্রঘোনা মিশন হাসপাতালের বারান্দায় কথা হয় লক্ষী রানী দে’র সাথে। তিনি জানান, রাঙামাটি রাজবাড়ি এলাকায় তার বাবার বাড়ী। বাবার নাম ক্ষিতিশ বিশ্বাস। কাপ্তাই বাঁধ তৈরীর ফলে তাদের পৈতৃক বাড়ী কাপ্তাই লেকে তলিয়ে যাবার পর স্বাধীনতার আগেই তারা স্ব-পরিবারে চন্দ্রঘোনা হিন্দু পাড়ায় মামার বাড়ীতে চলে আসেন। সেখান থেকে তার বিয়ে হয় রাউজান উপজেলার উনসত্তর পাড়া গ্রামের মানিক চন্দ্র দে’র সাথে। সুখেই চলছিল তাদের জীবন। স্বামী কৃষি কাজ করে সংসার চালাতো। এরই মধ্যে তার ২ সন্তান পৃথিবীতে আসে। কিন্ত সবার কপালে সুখ সয়না। তার প্রথম সন্তান লিটু দে মাত্র ১৩ বছর বয়সে দূরারোগ্য ব্যধিতে মারা যায় শশুর বাড়ীতে। তার বড় ছেলে মারা যাবার পর ৬ বছর পর আরেক ছেলে সুজয় দে মাত্র ১১ বছর বয়সে মারা যায়। ছেলে হারা লক্ষী রানীর জীবন যেন এক বিভীষিকায় পরিনত হয়।
ছেলে হারানোর ৮ বছর পর পুত্রশোক সইতে না পেরে লক্ষী রানী দে’র স্বামী মানিক চন্দ্র দে সকলকে শোক সাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান। স্বামী মরার পর তার জীবনে নেমে এসে আরো চরম দূর্বিষহ দিন। শশুর বাড়ীর লোকজনের অত্যাচারে তিনি এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে চন্দ্রঘোনা হিন্দুপাড়া মায়ের ঘরে চলে আসেন। সেখানেও তার সুখ পাখি যেনো অধরা হয়ে থাকে। সহায় সম্ভল যা ছিল তা নিয়ে তার এক ভাই চলে যান অন্যত্র।
এরপর তিনি চন্দ্রঘোনা খ্রীস্টিয়ান হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ মনোজ বড়ুয়ার বাসায় কাজ নেয়। ডাঃ মনোজ বড়ুয়া ছাড়াও মিশন এলাকার অনেকের বাসাবাড়ীতে ঝি’ এর কাজ করে কোন রকমে তার জীবন চলত।
এরই মধ্যে তার জীবনে আসে আরো একটি দুঃস্বপ্ন। ১৯৯২ সালে চোখে দেখা দেয় তার কঠিন রোগ। অপারেশন করতে গিয়ে তিনি হারান তার দু’চোখ। চোখ হারানোর পর মানুষের বাসায় তার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এখন মানুষের দেওয়া অন্ন বস্ত্রে তার জীবন চলে। যেদিন পায় সেদিন খায়, না পেলে কখনোও পানি খেয়ে হাসপাতালের বারান্দায় ঘুমিয়ে যান লক্ষী রানী দে।
কথা হয় মিশন হাসপাতালের সামনের গেইটে দীর্ঘদিন ধরে ফল বিক্রেতা আব্দুল আউয়ালের সাথে। তিনি জানান, এ মহিলা দীর্ঘ ২০ বছর ধরে দিনের বেলা তার দোকানে বসে থাকেন, সন্ধ্যা হলে হাসপাতালের বারান্দায় চলে যান। অনেকে এসে কিছু সহায়তা করে থাকে।
চন্দ্রঘোনা খ্রীস্টিয়ান হাসপাতালের নিরাপত্তা প্রহরী মোঃ সিরাজ, জুনু চাকমা জানান, হাসপাতালের বারান্দায় ওই মহিলা রাত্রি যাপন করেন। হাসপাতালের সামনে অন্ধ এই মহিলাকে আমরা সবসময় চোখে চোখে রাখি, খাবার দিই।
হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ প্রবীর খিয়াং জানান, একবার ওই মহিলাকে টাকা পয়সা দিয়ে তার এক আত্মীয়ের বাসায় দিয়ে এসেছিলাম। কিন্ত তিনি আবার হাসপাতালের সামনে ফিরে আসেন। তাই মানবিক কারনে আমরা উনাকে থাকতে দিয়েছি। তিনি আরো জানান, হাসপাতালের পক্ষ হতে উনাকে আমরা প্রায়ই খাবার দিয়ে থাকি। তবে এই মহিলাকে যদি পূর্নবাসন করা যায়, সে ক্ষেত্রে আমরা সহায়তা করবো।