বর্ষা বন্দনা

নাহিদ সুলতানা
“যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো,
চলে এসো,এক বরষায়।
এসো ঝরো ঝরো বৃষ্টিতে
জল ভরা দৃষ্টিতে
এসো কোমল শ্যামল ছায়।
তুমি চলে এসো, চলে এসো,
এক বরষায়।”
জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদের লেখা গান। তিনি বর্ষা ঋতুকে অনেক ভালবাসতেন।তার অনেক উপন্যাসে বর্ষার বৃষ্টিকে তিনি আবেগ দিয়ে নানান ভাবে উপস্থাপিত করেছেন।
 আষাঢ় মাসের মধ্য দিয়ে প্রকৃতিতে গ্রীষ্মের রুদ্র দহন ছিন্ন করে বর্ষা ঋতুর আগমন।তৃষ্ণার্ত প্রকৃতি বর্ষার জল পান করে ফিরে পায় প্রাণস্পন্দন! প্রকৃতি সবুজ- সমারোহে ভরে ওঠে, ফুলে- ফলে শোভিত হয়।
বর্ষা নিয়ে মহাদেব সাহা বলেছেন–
“কাগজ আবিষ্কারের আগে মানুষ প্রেমের কবিতা লিখে রেখেছে আকাশে।সেই ভালবাসার কবিতা এই বৃষ্টি,এই ভর বর্ষা।”
বর্ষা ঋতু লেখকদের মনে অনেক প্রভাব বিস্তার করে।বর্ষা যেন কবিদের ঋতু! সাহিত্যের প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত  বর্ষা নিয়ে কবিরা লিখেছেন অনেক কবিতা, গান।লেখকরা লিখেছেন অনেক গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ- নিবন্ধ।বিশ্বকবি  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার গীত বিতানে শুধু বর্ষা নিয়ে ১২০টি গান লিখেছেন।
বর্ষা মানে সময়- অসময়ে ঝুমঝুম বৃষ্টি, কাঁদামাখা পথঘাট,খাল- বিলে থৈ থৈ পানি, নদীতে বয়ে চলা ছবির মতো পাল তোলা নৌকার সারি।বর্ষার নতুন জলে স্নান সেরে প্রকৃতির মন ও যেন নেচে ওঠে।তাল তমাল, শাল পিয়াল আর মরাল কপোতের বন বীথিকায় চোখে পড়ে বকুল, কদম, কেতকী,জারুল, পারুল, কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়াসহ অসংখ্য ফুল।
বর্ষার প্রথম মাসে আষাঢ়ের অগ্রদূত কদম ফুল।বর্ষার আগেই গাছে গাছে কদমফুলের সমারোহ যেন আষাঢ়কে স্বাগত জানায়।
বর্ষার কদমফুল নিয়ে কবিগুরু আবেগ দিয়ে লিখেছেন :
” বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান
আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান।”
বর্ষা ঋতু কাব্যময়, প্রেমময়। বর্ষার প্রবল বর্ষণে নির্জনে ভালবাসার সাধ জাগে।কদম ফুলের মতো তুলতুলে নরম, রঙিন স্বপ্ন দু’চোখের কোণে ভেসে ওঠে।কবির কবিতায়,শিল্পীর সুরে- গানে, চারুশিল্পীর তুলির আঁচড়ে,নকশীকাঁথার ফোঁড়ে ফোঁড়ে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভান্ডারে বর্ষার অপরূপ রূপ বর্ণনা,স্থিতি ও ব্যাপ্তি মূর্ত ও চিরকালীন হয়ে আছে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়–
“নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে
ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।”
মহাকবি কালিদাস তার ‘মেঘদূত’ কাব্যে আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে বিরহ কাতর মেঘ কে দূত করে কৈলাশে পাঠিয়েছিলেন তার প্রিয়ার কাছে।যক্ষের সে বিরহ বার্তা মেঘদূত যেন সঞ্চারিত করে চলেছে প্রতিটি বিরহ কাতর চিত্তে, যুগ হতে যুগান্তরে।বৃষ্টির শব্দে যক্ষের মতোই বাঙালির হৃদয় এক অজানা বিরহে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।
বিরহের কবি চন্ডিদাস বর্ষাকে হৃদয়ের পোড়া ছাইয়ের অনুষঙ্গ করে প্রকাশ করেছেন।বিরহ কাতরতাকে মেঘের ঘনকালো রূপের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
” এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা কেমনে আইল বাটে
আঙিনার মাঝে বধুয়া ভিজিছে দেখিয়া পরাণ ফাটে।”
পঞ্চদশ শতকের মৈথলী কবি বিদ্যাপতি বুকের ভেতর আগলে রাখা বেদনাকে প্রকাশ করেছেন ভরা ভাদরের বেদনার্ত রূপের সঙ্গে মিল করে:
” এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর – এ ভরা ভাদর মাহ বাদর, শূন্য মন্দির ও মোর।”
পল্লীকবি জসিম উদদীনের কবিতায় –
“আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছলছল জলধারে
বেণু-বনে বায়ু নীড়ে এলোকেশ, মন যেন চাই কারে।”
 জাতীয় কবি নজরুলের ভাষায়–
“যে দেশে যবে বাদল ঝরে কাঁদে নাকি প্রাণ একলা ঘরে
বিরহ ব্যথা নাহি কি সেথা বাজে না বাঁশি নদীর তীরে।”
রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন–
” আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে
জানি নে জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না।
মেঘমল্লার সারাদিনমান,বাজে ঝরনার গান,
মম হারাবার আজি বেলা,পথ ভুলিবার খেলা।”
রবীন্দ্রনাথ ‘বর্ষার দিনে’ কবিতায় বলেছেন–
“এমন দিনে তারে বলা যায়,  এমন ঘনঘোর বরিষায়,
এমন মেঘস্বরে বাদল – ঝরঝরে, তপনহীন ঘন তমসায়।”
কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায়–
“এই জল ভালো লাগে,বৃষ্টি রূপালি জল কতদিন এসে
ধুয়েছে আমার দেহ – বিলায়ে দিয়েছে চুল – চোখের উপর।
তার শান- স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে,আবেগের ভরে
ঠোঁটে এসে চুমো দিয়ে চলে গেছে কুমারীর মতো ভালবেসে।”
কবি আল মাহমুদের ভাষায়–
” শুধু দিগন্ত বিস্তৃত বৃষ্টি ঝরে যায়
শেওলা পিছল আমাদের গরিয়ান গ্রহটির গায়।”
বর্ষাকে নিয়ে কবিদের লেখার অন্ত নেই।তাই বর্ণনা করে ও শেষ করা যাবে না।বর্ষা প্রকৃতিকে প্রণবন্ত ও সজীব করে তোলে।কিন্তু অতি বৃষ্টির কারণে নগর জীবনে আবার  দূর্ভোগ ও নেমে আসে।মানুষের অপরিকল্পিত স্থাপনা, বন উজাড় করা, আরো অনেক মানবসৃষ্ট কারণে এখন দেখা যায়  বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতে ও রাস্তা ঘাট ডুবে যায়,নালা- নর্দমার নোংরা পানিতে সড়ক ডুবে থাকে, জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।।যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, অনেক স্থান পানিতে ডুবে থাকে।অনেক এলাকায় বন্যায় মানুষ গৃহবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন কাটাতে বাধ্য হয়। অনেকের ঘরবাড়ি, ফসল,বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়।মানুষের কষ্টের সীমা থাকেনা।এছাড়া বজ্রপাতে ও অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এ সবকিছু ঘটে মানুষের সৃষ্ট পরিবেশ দূষণের কারণে।তা নাহলে প্রকৃতিতে বর্ষা ঋতু আসে আর্শীবাদস্বরূপ!
দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে বর্ষা ঋতু যেন আমাদের আর্শীবাদ হয়েই থাকে।অতি বর্ষন কিংবা বন্যার কবলে যেন দেশবাসীকে পড়তে না হয়।বজ্রপাতে যেন কারো প্রাণহানী না হয়।