বরেণ্য শিক্ষক মরহুম আকতার আহমদ

জিয়া হাবীব আহসান:::

১৯ শে রমজান, আজকের এই দিনে আমরা হারিয়েছিলাম বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনের পথপ্রদর্শক, জনপ্রিয় শিক্ষক, সমাজ সেবক ও মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট সংগঠক শ্রদ্ধেয় আকতার আহমদ মাষ্টার স্যারকে । আজ তাঁর ২য় মৃত্যু বার্ষিকী । শিক্ষকদের কখনো মৃত্যু হয় না, ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে কিন্ত শিক্ষক বেঁচে থাকে তাঁর অগণিত ছাত্র-ছাত্রীদের মনের মাঝে, কর্মের মাঝে কৃতিত্বের মাঝে, সফলতার মাঝে । শিক্ষক মানে মূলত জীবনের পথ প্রদর্শক, অন্ধকার পথের আলোকবর্তিকা । ঠিক সে অর্থেই তিনি ছিলেন অন্ধকারের আলোকবর্তিকাই । মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালে তিনি চন্দনপুরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক থাকা অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার রান্না করে খাওয়াতেন। স্কুলে থাকতে দিয়ে ও খাবারের ব্যাবস্থা করে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতা করতেন । তিনি একজন আদর্শ নীতিবান শিক্ষক হিসেবে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ও সংগঠক ছিলেন এবং প্রাথমিক শিক্ষকদের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন । তদানীন্তন চট্টগ্রাম জেলার বর্তমানে কক্সবাজার জেলার উখিয়া থানাধীন ভালুকিয়া পালং গ্রামে ১৯৪৭ সনের ৩১শে ডিসেম্বর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতার নাম মাওলানা মোজাহেরুল হক, তিনি একজন বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন ছিলেন এবং মাতা উমর খাতুন । মরহুম আকতার আহমদের মাষ্টারের বড় ভাই মোখতার আহমদ তিনিও পেশায় একজন প্রধান শিক্ষক এবং তাঁর ছোট ভাই সামসুল আলমও একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন । মরহুম আখতার আহমেদ মাষ্টারের বড় ভাই মোখতার আহমেদ আমার ভগ্নীপতি এডভোকেট সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের ভগ্নীপতি হওয়ায় আমারও আত্নীয় হয়ে যান । তবে তরুণ সমাজকর্মী স্নেহাশিস লায়ন মাহমুদর রহমান শাওনের পিতা হিসেবে আমার সাথে বেশি ঘনিষ্ঠতা । এডভোকেট আনোয়ার ভাইয়ের চেম্বার ও বাসায় প্রায় তিনি আসতেন এবং আমাদের সাথে দীর্ঘ সময় জ্ঞানোচিত আলাপ আলোচনা করতেন । আমার স্নেহধন্য জুনিয়র ও ছোট ভাই এডভোকেট সৈয়দ মোহাম্মদ হারুনের পিতা মরহুম হায়দার মাষ্টারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন । আপনজনদের সাথে মেলামেশার সুবাদে এই অসাধারণ ক্ষণজন্মা শিক্ষক নেতার সম্পর্কে আমার জানার কিছু সুযোগ হয় । তিনি অত্যন্ত স্পষ্টভাষী ও সত্যদশী শিক্ষক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন । ১৯৬৪ সালে এস.এস.সি পাশ করেন এবং ১৯৬৫- ১৯৬৬ শিক্ষাবর্ষে সি.ইন.এড এবং ময়মনসিংহ ট্রেনিং সেন্টার থেকে উচ্চতর সি.ইন.এড প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন । ১৯৬৫ সালে উখিয়া মরিচ্চা পালং সরকারী প্রাথমিক বিদ্যলয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন । তিনি আমাদের চট্টগ্রাম জেলার মোহাম্মদীয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, চন্দনপুরা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, মিউনিসিপ্যাল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় চট্টগ্রাম, তারপর কক্সবাজার জেলার পাকৃকাটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, কোতোয়ালী বান্ডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাঠানপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাথরঘাটা বালক বিদ্যালয়, বাগমণিরাম বিদ্যালয়, আমবাগান বিদ্যালয়, সর্বশেষ সাবিত্রী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকুরীশেষে ৩০শে ডিসেম্বর ২০০৪ ইংরেজী অবসর গ্রহণ করেন । কর্মজীবনে পেশাজীবী সংগঠনের দায়িত্বে প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি চট্টগ্রাম মহানগরীর সভাপতি ২ বছর ও মহানগর দপ্তর সম্পাদক ১৫ বছর ছাড়াও কোতোয়ালি থানা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও যুগ্ম সম্পাদকসহ বিভিন্ন পদে প্রায় ১ যুগ দায়িত্ব পালন করেন । সমাজ সেবায় তার জুরি নেই। তিনি অত্যন্ত পরোপকারী মানুষ ছিলেন । মানুষের বিপদে আপদে সাধ্যিনুযায়ী সহযোগিতা করা তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । এ জন্যে অনেক সময় তাকে বিপদেও পড়তে হয় । আমাদের দেশের অবহেলিত বঞ্চিত প্রাইমারি শিক্ষকদের দূ:খদূর্দশা লাঘবে তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন । তাই প্রাথমিক শিক্ষকদের হৃদয়ের স্পন্দনে পরিনত হয়েছিলেন । তাদের জীবন মান উন্নয়নের সংগ্রামে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য । মরহুম শুধু একজন আদর্শ শিক্ষকই ছিলেন না পাশাপাশি তিনি একজন সমাজ সংস্কারকও ছিলেন । শিক্ষার্থীদের মাঝে ও সমাজে নৈতিকতা শিক্ষায় তার বিরাট ভূমিকা ছিল । যৌতূক প্রথা উচ্ছেদ, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে তিনি সোচ্চার কন্ঠস্বর ছিলেন । সন্তানদেরও তিনি ধন সম্পদ আহরণের চেয়ে পরোপকারিতাও নৈতিকতার শিক্ষা দেন । এমন স্বার্থহীন মানুষ সমাজে খুঁজে পাওয়া কঠিন । লায়ন মাহমুদুর রহমান শাওন তাঁর বাবার প্রসঙ্গে গল্প করতে গিয়ে একদিন আমাকে বলেছিল- ভাইয়া একটা গর্বিত ঘটনা আপনাকে আমি বছর খানেক আগে বলেছিলাম, আব্বা ওনার ছাত্র রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিব সম্পদ বড়ুয়ার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো বঙ্গভবনে । তখন আব্বার ছাত্র আব্বাকে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে নিয়ে যায় । মহামান্য রাষ্ট্রপতি ওনার পিএসের শিক্ষক শুনে চেয়ার থেকে ওঠে জড়িয়ে ধরে, প্রায় আধ ঘন্টা গল্প করে ও খুব সম্মান করে আপ্যায়ন করে । আব্বার ভাষায় ওনার জীবনে এটা একজন শিক্ষক হিসেবে সর্বোচ্ছ সম্মান । মানুষটা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত খুব গর্বের সহিত এটা বলতো । তাছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মীর আহমদ, চট্টগ্রাম মেডিকেলের প্যাথলজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ডা: মাজেদ ও বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ এম এ রউফসহ উনার অসংখ্য ছাত্র সচিব, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার । ১৯৮৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর নগরীর লালখানবাজার নিবাসী ব্যবসায়ী তমিজুর রহমানের বড় কন্যা জাহানারা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় । ছেলে মেয়ে ৩ জন । ১ম মেয়ে হাসিনা বেগম, ২য় মেয়ে ফারজানা আকতার ইরানি, ছোট ছেলে লায়ন মাহমুদুর রহমান শাওন । আকতার আহমেদ মাষ্টার আর নেই। কিন্তু তাঁর হাতে গড়া অসংখ্য গুপ্তী মানুষ সমাজে নানা ক্ষেত্রে অবদান রেখে যাচ্ছেন । যার মাধ্যমে তিনি যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন । আমরা বর্তমানে গুণীজনদের সঠিক মর্যাদা দিতে জানি না । কথায় আছে যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণীর জন্ম হয় না । প্রায়ই লোক মুখে বলতে শোনা যায়, এখন আর জ্ঞানী লোক তেমন চোখে পড়ে না । তাহলে কি জ্ঞানীরা একটা প্রজন্মের মানুষ ? সেই প্রজন্মের সাথেই শেষ হয়ে যাবে জ্ঞানীদের সমারোহ ! নাকি আমরা জ্ঞানের সমাদর জানি না, করি না বিধায় জ্ঞানের দীপ্তি ধীরে ধীরে নিস্প্রভ হয়ে যাচ্ছে ? জ্ঞানীরা থাকছেন ম্রীয়মাণ । সাধারণত জ্ঞানীরা ফলবান বৃক্ষের মতো নুইয়ে থাকেন । এটাই তাদের সৌন্দর্য । সেই সৌন্দর্যের প্রতি সম্মানই তাদের উৎসাহ যোগায় । সন্তানকে যেমন লালন-পালন করে বড় করতে হয়। একটি গাছকে পরিচর্চা না করলে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না । সেখানে গুণের সমাদর না করলে গুণী সমুন্নত থাকে কি করে ? মানুষ তার নিজ প্রয়োজনেই পরিবার এবং পারিপার্শ্বকতার প্রতি যত্মবান হয় । ফলে তা থেকে সে উপকৃত হয় । পরিবারের প্রতি যত্মশীল না হলে পরিবার থেকে সে তো কিছু পায়-ই না এবং পরিবারটিও ধ্বংস হয়ে যায় । কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়-এই সহজ সমীকরণ ভুলে গেলে পস্তাতে হয় বৈকি ? তাছাড়া আমাদের সমাজে ভালো লোকের অভাব নেই । কিন্তু তাদের যেমন সমাদর নেই, তেমনই রয়েছে সমঝদারের অভাব । আজকের সমাজে কেউ ভালো কোনো কাজ করলে তার প্রশংসা করার আগে খোঁজ করা হয়, তার কোনো দূরভিসন্ধি আছে কি-না । কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার ভাগ্যে জোটে উপহাস । এভাবে মানুষ ভালো কাজের প্রতি নিরুৎসাহী হচ্ছে এবং সাহস হারাচ্ছে । তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর উছিয়ত অনুযায়ী উখিয়া নিজ গ্রামে পৈতৃক গোরস্থানে সমাহিত করা হয় । আমি মরহুমের সৎকর্ম সমূহ কবুল করে তাঁকে জান্নাতের উচ্চ মাকামে স্থান দিতে মহান আল্লাহ পাক রহমানুর রাহীমের শাহী দরবারে মুনাজাত করছি, আমিন ।

লেখকঃ আইনজীবী, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসনকর্মী।