করোনাকালে নীরবে চলে গেলেন ঢাকার শেষ আর্মেনিয়ান

অনেকটা নীরবেই প্রস্থান ঘটলো পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী আর্মেনিয়ান সম্প্রদায়ের অবশিষ্ট মানুষটির। বাকীরা আগেই চলে গেছেন। কেউ কবরে, বেশির ভাগই বাংলাদেশ ছেড়ে গেছেন। স্বজন-পরিজনহীন অবস্থায় মাইকেল জোসেফ মার্টিন বাংলাদেশের মাটি কামড়ে পড়েছিলেন অনেকটা আবেগে। হয়তো চেয়েছিলেন জীবনের বাকিটা সময় এখানেই কাটাতে। কিন্তু না, স্রষ্টার অমোঘ নিয়তি। কানাডায় থাকা সন্তানদের কাছে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। গত ১১ ই এপ্রিল ধরণী থেকে তার প্রস্থান হলেও করোনার এই কঠিন সময়ে খবরটি চাউর হয়েছে বেশ দেরিতে।
তা-ও ঢাকার কোনো সংবাদ মাধ্যমে নয়, একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে। ৯ই মে এ নিয়ে একটি আবেগঘন ফিচারধর্মী স্টোরি করে এএফপি। ঢাকা ব্যুরো চিফ শফিকুল আলম প্রতিবেদনটি তৈরি করেন। যেখানে ঢাকায় আর্মেনিয়ান বসতির ৩০০ বছরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও তুলে ধরা হয়েছে। কথা হয় তার সঙ্গে। শফিক বলেন, বয়োবৃদ্ধ মার্টিন বার্ধক্যজনিত রোগে মারা গেছেন এবং সেটা কানাডাতে। বৈশ্বিক মহামারি করোনা কোভিড-১৯ এর চাপে হয়ত ঢাকায় তার মৃত্যু সংক্রান্ত বার্তাটি এসেছে একটু দেরিতে। কিন্তু এখানে দেরি বিবেচ্য নয়, কারণ মার্টিনের চির বিদায়ের সঙ্গে ঢাকায় আর্মেনিয়ান সম্প্রদায়ই কার্যত বিদায় নিলো, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সংবাদটি করা হয়েছে। মিস্টার আলম এর আগেও তাকে নিয়ে অনেক স্টোরি করেছেন। সাক্ষাতকার নিয়েছেন বহুবার। তার মতে, ৮৯ বছর বয়সী মার্টিন বয়সের ভারে ন্যুজ ছিলেন। তিনি যখন চলতে ফিরতে প্রায় অক্ষম তখন মেয়েরা তাঁকে কানাডায় নিয়ে যান। সেখানে তার জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছে। এএফপির রিপোর্টে মার্টিনের ঢাকায় পড়ে থাকার বিষয়ে যে বিষয়গুলোকে নিয়ামক হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে তা হলো- মার্টিন বহু আগেই চলে যেতে পারতেন, এখানে তার থাকার কোনো দায় ছিল না। অন্তত শরীরে শক্তি সামর্থ থাকা অবস্থায় তিনি কানাডায় স্ব-পরিবারে বসবাসরত ৩ মেয়ের কাছে গিয়ে আরাম আয়েশে জীবনটা কাটাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। নির্লোভ ওই মানুষের কাছে অর্মেনিয়ান চার্চে সমাহিত তার পূর্বপুরুষদের কবরগুলো ছিল অনুপ্রেরণা। সারিবদ্ধভাবে পরিপাটি করে সাজানো ওই সামাধিস্থলে চিরদিনের জন্য শায়িত তার জীবন সঙ্গীনিও, যিনি ২০০৬ সালে প্রয়াত হয়েছেন। মার্টিন ওই সামাধির ফুলগুলোর সঙ্গে সময় কাটাতেন। সমাধির ছায়াবৃক্ষগুলোর পরিচর্যায় তিনি আনন্দ পেতেন। চার্চেই থাকতেন, খুব একটা বাইরে বের হতেন না।
ঢাকা নিয়ে গবেষণা করছেন এমন এক তরুণ গবেষক যিনি সাংবাদিকতাও করেন (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) তিনি বলছিলেন, ২০০৮ সালে আর্মেনিয়ান চার্চ নিয়ে কাজ করতে গিয়েছিলেন তিনি। তখন মার্টিনের সাক্ষাত পেতে তার গেটের বাইরে একাধিক দিন দাঁড়াতে হয়েছে। এতে তিনি বিরক্ত হয়েছে, কষ্ট লেগেছে কিন্তু প্রাণবন্ত মার্টিনের সাক্ষাত পাওয়ার পর বিশেষত তার কথাবার্তা শুনে তিনি কেবল কষ্ট ভুলেনি, বরং মুগ্ধ হয়ে ফিরেছিলেন। ওই গবেষকের মূল্যায়ন মার্টিন এতো বছর বাংলায় কাটালেও তিনি পুরোদস্তুর আর্মেনিয়ানই ছিলেন, ভাষা-সংস্কৃতিতে তার একটুও পরিবর্তন আসেনি।

উল্লেখ্য, ঢাকায় প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো আর্মেনিয়ান সমাধি রয়েছে। সেটি ধরেই হিসাব করা হয় ঢাকায় আর্মেনিয়ানদের বসবাসের বয়স। সেই বিবেচনায় ৪০০ বছরের ঢাকার বয়সের কাছাকাছি হবে ওই সম্প্রদায়ের বসতির বয়স। কিছু কম হতে পারে, যদি না প্রয়াত ওই ব্যক্তি এখানে ঘুরতে এসে না মারা যান। তবে ওই সম্প্রদায়ের ঢাকার বসতি যে ৩০০ বছরের কম নয় সে বিষয়ে গবেষকরা একমত। মূলত বণিক, বাণিজ্যে সুবাদে বঙ্গে আর্মেনিয়ান সম্প্রদায়ে আগমন। বলা হয় এক সময়ের প্রধান অর্থকড়ি ফসল পাটকে বিশ্ববাজারে তারাই পরিচিত করেছিলেন। তছাড়া এখানে প্রশাসন, আইন পেশাসহ বিভিন্ন পেশাতেও আর্মেনিয়ানরা ছিলেন। সংখ্যায় হয়তো তারা বেশি ছিলেন না, কিন্তু বাংলার অর্থনীতি এবং সমাজে আর্মেনিয়ান সম্প্রদায়ের যে তাতপর্যপূর্ণ অবদান রয়েছে, সেটা অনস্বীকার্য।