করোনা-পরবর্তী উহানবাসীর ডিস্টোপিয়ান জীবন

উহানের উপকণ্ঠে অবস্থিত লেনোভো ট্যাবলেট ও ফোন ফ্যাক্টরিতে প্রতি কর্মদিবসে কর্মীদের কমপক্ষে চারবার তাপমাত্রা পরিমাপ করে সুপারভাইজারকে রিপোর্ট করতে হচ্ছে। সেখানে কারো তাপমাত্রা যদি ৩৭.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে দেখা যায় তবে তাকে সঙ্গে সঙ্গে চিহ্নিত করা হয় এবং অ্যান্টিভাইরাস টাস্কফোর্স দ্বারা তদন্ত শুরু হয়।

নভেল করোনাভাইরাসের মহামারী সামলে ২৮ মার্চ থেকে ফের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে উহানে অবস্থিত কারখানাটি। এ শহরে সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে সবকিছু নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। কাজে ফেরার আগে স্টাফদের ভাইরাস ও অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করতে হচ্ছে এবং ফল আসা পর্যন্ত অন্য ডরমিটরিতে আইসোলেশনে থেকে অপেক্ষা করতে হয়। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে তারা কাজে ফিরতে পারে। শ্রমিকরা কাজে ফিরে দেখেছেন ছয়জনের মিটিং রুমকে তিন রুমে নিয়ে আসা হয়েছে। যেখানে জিনিসপত্র পৌঁছে দেয়ার জন্য রোবট ব্যবহার করা হচ্ছে, যেন মানুষের বারবার স্থান পরিবর্তন করতে না হয়। সর্বশেষ কবে জীবাণুুমুক্ত করা হয়েছে, সেই চিহ্নও উল্লেখ করা আছে। লিফটগুলোও এখন অতীতের নিদর্শনে পরিণত হয়েছে। সবাই এখন সিঁড়ি ব্যবহার করছে, যেন একজন আরেকজনের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলা যায়।

উহানে লেনোভো গ্রুপ লিমিটেডের হেড অব অপারেশনের দায়িত্ব পালন করছেন কিউই ইউয়ে। যার কাজ এখন ফ্যাক্টরিকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা এবং ভাইরাসমুক্ত রাখা। ফলে উৎপাদন কতটা হচ্ছে তা এখন দ্বিতীয় প্রধান বিষয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

কিউই হচ্ছে উহানের সেসব মানুষের একজন যারা চেষ্টা করছেন শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারীর পর অর্থনীতি ও সামাজিক জীবন কেমন দেখাচ্ছে তার চেহারাটা অনুমান করার। হুবেই প্রদেশে এখন অবশ্য নতুন কোনো সংক্রমণের দেখা মেলেনি। যদিও অনেকেই চীনের এসব তথ্যকে সন্দেহের চোখে দেখছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা সতর্কবার্তা দিয়েছে। কার্যকর ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত নির্ভার হওয়ার সুযোগ নেই। এখন এ ঝুঁকির বিপরীতে ভারসাম্য তৈরি করা খুবই কঠিন একটি কাজ।

এখন পর্যন্ত উহান স্বাভাবিকতার একটি নিজস্ব উদাহরণ তৈরি করেছে, যা লন্ডন, মিলান অথবা নিউইয়র্কের কাছে এক মুহূর্তের জন্য হলেও সম্পূর্ণভাবে অপরিচিত মনে হতে পারে।

প্রতিদিনের কার্যক্রম শুরু হলেও এখনো সেখানে অনেক কার্যক্রমে বিধিনিষেধ রয়েছে। পাশাপাশি চীনের সরকারি ও বেসরকারি নজরদারি এতটাই শক্তিশালীভাবে কাজ করছে যেন সংক্রমণের কোনো ঘটনা কয়েক ঘণ্টার বেশি অনির্ণেয় না থাকে।

কিন্তু জনসাধারণ যা ভোগ করেছে তারপর তারা জানুয়ারির আগের মতো অবস্থায় ফিরতে পারবে কিনা তা পরিষ্কার নয়। শপিং মল ও ডিপার্টমেন্ট স্টোরগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেখানে তেমন কোনো জনসমাগম নেই। রেস্টুরেন্টের ক্ষেত্রে এটি একইভাবে সত্য। বিপরীতে মানুষ বরং অর্ডার দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। পাতালরেলগুলোও নীরব হয়ে আছে। যদিও অটো বিক্রি হচ্ছে। ফলে ট্রাফিকে আটকে থাকা বিরক্তির হলেও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত হওয়াটা স্বস্তির।

এর মাঝে কিউই সম্ভবত অর্থনৈতিক দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন। কারণ স্কুলগুলোতে দূরবর্তী অবস্থান থেকে শিক্ষাদানের পদ্ধতির কারণে ট্যাবলেটের চাহিদা বেড়েছে। এছাড়া বাসা থেকে বসে অফিস করার যে ভাবনা তা বলছে ভবিষ্যতে প্রযুক্তি খাতের বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা নেই।

এদিকে নতুনভাবে কাজ শুরুর পর তাকে এক হাজার শ্রমিক নিয়োগ দিতে হয়েছে এবং উৎপাদনের লাইনগুলোও সম্পূর্ণরূপে কার্যকর আছে।

কিউই জানান, তারা বেশ সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছেন। কারণ তিনি জানেন একজন কর্মীও যদি ভাইরাসে আক্রান্ত হন তাহলে সবকিছু এক মুহূর্তের মধ্যে থেমে যাবে। তাই স্টাফদের বারবার সতর্কবার্তা দেয়া হচ্ছে, যেন কোনোভাবেই গা ছাড়া ভাব দেখানো না হয়।

চীনে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল হুবেই প্রদেশে। যেখানে উহান হচ্ছে সবচেয়ে বড় শহর। শি জিনপিং সরকারের বেশকিছু ভুলের পর এখানে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। যেখানে ১০ দিনের মধ্যে তৈরি করা হয়েছিল হাসপাতাল। কার ও ইলেকট্রনিক কোম্পানিগুলো তৈরি করেছে সুরক্ষা পোশাক।

চীনে হুবেই প্রদেশেই সব শেষে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ৮ এপ্রিল থেকে এখানে নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়া হয়। ৭ এপ্রিল রাতে মানুষ উছাং স্টেশনে ভিড় জমায়। যেটি কিনা উহানের তিনটি বড় রেলওয়ে হাবের একটি। সপ্তাহের প্রথম ট্রেনটি ছেড়ে যাওয়ার আগে সেখানে উপস্থিত ছিল কালো পোশাক ও মেডিকেল মাস্ক পরা পুলিশ। যারা সবাইকে নিজেদের কোড স্ক্যান করার কথা বলে। এই স্বাস্থ্য কোড মূলত কভিড-১৯ মোকাবেলার জন্য তৈরি করেছে চীন। আলিপে এবং উইচ্যাট দ্বারা করা হলেও এটি সরাসরি সরকারি দপ্তরের সঙ্গে সম্পর্কিত। যেখানে ঝুঁকি বোঝাতে সবুজ, হলুদ ও লাল চিহ্ন দেখানো হয়। সবুজ কোডধারী কম ঝুঁকিপূর্ণ, কেউ আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে তখন তাকে হলুদ দেখানো হবে এবং কোয়ারেন্টিনে নিতে হবে। আর নিশ্চিত কেসের ক্ষেত্রে লাল চিহ্ন ব্যবহার করা হয়।

এক শহর থেকে অন্য শহরে ভ্রমণের জন্য আপনাকে সবুজ কোডধারী হওয়া আবশ্যক। অনেকে সবুজধারী হয়েও ভ্রমণের ক্ষেত্রে নির্ভার থাকতে পারেন না। কারণ যেকোনো মুহূর্তে সব বদলে যেতে পারে। তাপমাত্রা বাড়লেই আটকে দেয়া হবে। যে কারণে ২২ বছর বয়সী জেং জিয়াওর মতো অনেকে বারবার নিজের তাপমাত্রা পরিমাপ করতে থাকেন। কারণ খারাপ কিছু হলে জিয়াওর আর গুয়াংচু যাওয়া হবে না।

এরপর যখন ভোর হলো উহান খুব সতর্কতার সঙ্গে জীবন ফিরে পেল। যদিও স্বাভাবিক জীবনে ফেরার এ প্রক্রিয়া খুবই অস্থায়ী বলে মনে হচ্ছিল। প্রত্যেক মল ও পাবলিক বিল্ডিংয়ে তাপমাত্রা মাপার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পরিস্থিতি একটু খারাপ হলে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রস্তুতিও নেয়া ছিল। পাতালরেলে চলাফেরার জন্যও সবুজসংকেত পাওয়া জরুরি ছিল। কারণ কভিড-১৯-এর মুখোমুখি হওয়া প্রথম শহরটিতে বিপদ ফিরে আসার আশঙ্কা কমেনি। লক্ষণবিহীন সংক্রমিত মানুষ এবং বাইরে থেকে আসা ব্যক্তিরা সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ। এর মাঝে উয়াং হাসপাতালের ৩ হাজার ৬০০ জন স্টাফের অ্যান্টিবডি টেস্ট করা হয়। যাদের মাঝে ৩ শতাংশের কম লোকের পজিটিভ ফল দেখানো হয়। অর্থাৎ উহানে হার্ড ইমিউনিটির কোনো অস্তিত্ব নেই। যা মূলত আমাদের জানাচ্ছে, ভ্যাকসিন আবিষ্কারই একমাত্র সমাধান।

ব্লুমবার্গ/বণিক বার্তা