লাল কাঁকড়া-পাখির কলতানে

সমুদ্র। শব্দটি মনে হলেই নোনা জলের বড় বড় ঢেউ আছড়ে পরে মনের ভেতর। যেন ঢেউয়ের পানি নেমে যাবার সময় সাথে নিয়ে যায় ব্যস্ত জীবনের সব ক্লান্তি। বেশ আগে থেকেই পহেলা বৈশাখের ছুটি ঢাকার বাইরে কাটানো নিয়ে পরিকল্পনা আঁটছিলাম আমরা অনেকে মিলে। ভিন্ন ভিন্ন ক্যারিয়ারের মানুষ এক সাথে হলে যা হয়। সময়ে সময়ে পরিকল্পনার বদল। কখনো চা বাগান তো কখনো পাহাড়। এভাবেই শেষমেশ গন্তব্য বিশাল সমুদ্র সাগর কন্যা কুয়াকাটা।

ছোট বড় মিলিয়ে আমরা মোট আট জনের দল। এর মাঝে দু’জনের বয়স মাত্র চার ছুঁই ছুঁই করছে। বাসে করে ঢাকা থেকে কুয়াকাটার দীর্ঘ যাত্রায় তাই কনিষ্ঠ দুই সদস্যকে নিয়ে যে কিছুটা দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম না তা কিন্তু নয়। তবে এটুকু বলতে পারি ট্যুর শেষে সব থেকে বেশি প্রাপ্তিও ছিল কনিষ্ঠ দুই জনার।
কুয়াকাটায় আমার এর আগেও যাওয়া হয়েছে। তাই গতবারের অনেক অপূর্ণতাকে এবার পূর্ণতায় রূপ দিতে কুয়াকাটাকে নিয়ে আমার আগ্রহ বরং একটু বেশিই ছিল। কক্সবাজারের চাইতে কেন যেন কুয়াকাটা আমার কাছে একটু আলাদা। শহর বলতে সাগর পাড়ের বেড়িবাঁধের কোল ঘেঁষা জনপদ। এখানেই পর্যটকদের থাকার জন্য ছোট-বড় আবাসিক হোটেলগুলোর ভির। ঢাকা থেকে বাসে করে আসতে পথে দুই জায়গায় ফেরিতে প্রায় ৫ ঘণ্টা সময় নষ্ট হবার কারণে কিছুটা দেরিতেই পৌঁছাই আমরা। হোটেল বুকিং যেহেতু ঢাকা থেকেই দেয়া ছিল বাস থেকে নেমে প্রথম গন্তব্য তাই হোটেল রুম।
আগেই বলেছি কক্সবাজারের থেকে কুয়াকাটা আমার কাছে একটু আলাদা। কক্সবাজারে বিশাল সমুদ্রের পাশে বিশাল বিশাল অট্টালিকা আর হাজার হাজার মানুষের মাঝে যেন দু’দ- অবসর পাওয়া খুব কষ্ট। অন্যদিকে কুয়াকাটা এখনো অনেকটা অবসরের জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বুক উজার করে। আছে প্রকৃতি, আছে নদীর মোহনা, আছে লাল কাঁকড়ার দল, আছে প্রাকৃতিক বনভূমি লেবুর চর, ঝাউ বন, আর উপকূলীয় ফাতারার বনের হাতছানি। ফলে সমুদ্র ছাড়াও কুয়াকাটার রয়েছে নানান  বৈচিত্র্য। এখানে আপনি সমুদ্রকে একপাশে রেখে আনমনে হেঁটে চলে যেতে পারবেন প্রকৃতির কাছাকাছি। বিরক্ত করার যেন কেউ নেই।
প্রথম দিন যেহেতু পৌঁছাতেই আমাদের প্রায় দুপুর তাই হোটেলে যে যার রুম বুঝে নিয়েই বেড়িয়ে পরি পেটকে শান্ত করার জন্য। খাওয়া শেষ হতে দেরি সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পরতে যেন দেরি হয়নি আমাদের। যাত্রার সব ক্লান্তি সমুদ্রকে দিয়ে যখন আমরা হালকা তখন দিন প্রায় শেষের পথে। পূর্ব পরিচিত স্থানীয় গাইড সালেহর পরামর্শে তাই ফ্রেশ হয়েই সূর্যাস্ত দেখার জন্য বেড়িয়ে পড়ি সব্বাই মিলে। গন্তব্য তিন নদীর মোহনা, ৮-১০ মিনিটের এই পথ যেতে হবে মোটরসাইকেলে। যদিও কুয়াকাটায় ঘুরে বেড়ানোর জন্য এই মোটরসাইকেলের কোনো বিকল্প নেই। সমুদ্রকে বাঁ-পাশে রেখে আমারা ছুটে চলেছি পশ্চিম দিকে। সূর্য ততক্ষণে সমুদ্রে ডুব দেই দেই করছে। তিন নদীর মোহনায় পৌঁছেই আমরা সূর্যকে তার সব আলোকছটা নিয়ে সমুদ্রে ডুব দিতে দেখলাম। এ এক অদ্ভুত সময়। মানুষ বলতে ছিলাম শুধুই আমাদের দল। সবার মধ্যেই কেমন যেন এক অদ্ভুত নীরবতা। কানে শুধু শো শো বাতাসের শব্দ। এর মাঝেই দলের একটি অংশ আবার নদীতে চলা এক নৌকায় ওঠে কিছুটা নৌকা ভ্রমণ সেরে নিলো। সূর্য তার নতুন গন্তব্যে ফিরে গেলে আমরাও ফেরার পথ ধরলাম, গন্তব্য কুয়াকাটার প্রধান সৈকত।
ফিরতে ফিরতে চারপাশে অন্ধকার নেমে এসেছে। সমুদ্রে জোয়ার শুরু হয়ে গেছে। মোটরসাইকেল ছুটে চলছে আপন গতিতে। হঠাৎ লাইটের আলোতে আবিষ্কার করলাম সাগর পাড়ের বালু থেকে বেড়িয়ে আসছে হাজার হাজার লাল কাঁকড়া। ছোটাছুটি করছে এদিক সেদিক। কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেলাম আমরা, কাঁকড়া দেখব বলে। যেদিকে তাকাই শুধুই কাঁকড়ার দল। একটু কাছে যেতেই দৌড়ে গর্তে ঢুকে যাচ্ছিল। কিছুটা সময় লাল কাঁকড়ার সাথে খেলা শেষে আবার ছুটে চলা। সমুদ্রকে এবার ডান পাশে রেখে ছুটছে আমাদের মোটরসাইকেলগুলো। প্রচ- বাতাসের শব্দে কানে তালা লেগে যাবার জোগাড়। জোয়ারের পানি বাড়তে থাকায় মাঝে মাঝেই পানি দিয়ে ছুটে চলছিলাম আমরা। সৈকতে ফিরতে দেখি কুয়াকাটার আরেক রূপ, রাতের কুয়াকাটা। ছোট ছোট দোকানগুলোতে আলো জ্বলজ্বল করছে। পর্যটকেরা ব্যস্ত সামুদ্রিক মাছ ভাজা খাওয়াতে। দেরি না করে আমরাও নাম লেখাই সেই দলে।
এখন দেশের যেকোনো সমুদ্র সৈকতের বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে সামুদ্রিক মাছ ভেজে খাওয়া। এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়। নির্দিষ্ট একটি জায়গায় ১০ থেকে ১৫টি দোকান বাহারি সামুদ্রিক মাছের পসরা সাজিয়ে বসেছে। টুনা, লাক্ষা, কোরাল, রূপ চাঁদা, কাঁকড়া, স্কুইড, লইটকাসহ আরো নাম না জানা বাহারি মাছ। পছন্দসই মাছের অর্ডার দিয়ে সমুদ্রের গর্জন শুনতে শুনতে ডাবের পানিতে গলা ভেজানোর আহ কি সুখ!
আমরা সাধারণত কোথাও ঘুরতে গেলে সেখানে পাওয়া লোকাল খাবারের প্রতি বেশি আকর্ষণ বোধ করি। ফলে কুয়াকাটার তরমুজ, নির্ভেজাল কলা ইতিমধ্যেই আমরা রুমে নিয়ে জড়ো করেছি। আজকে আমাদের দ্বিতীয় দিন, আগের দিনের ক্লান্তিতে আজ একটু অলসতা দিয়ে শুরু করতে চেয়েছি। ফলে সকালে কোনো পরিকল্পনা রাখিনি আমরা। আগের রাতে মাছ ভাজা খাওয়াকে আজকে আরো বড় আকার দেয়ার ইচ্ছা থেকেই চলে যাই স্থানীয় মাছের পাইকারি বাজারে। সেখান থেকে পছন্দসই মাছ কিনে বুঝিয়ে দেই গাইড সালেহর হাতে। এরপর সময় শুধুই দল বেঁধে সমুদ্রের পানিতে নিজেদের উজাড় করে দেয়া।
বিকেল পর্যন্ত বিশ্রাম নিয়ে আমরা বেড়িয়ে পরি একটা দীর্ঘ সময়ের যাত্রায়। এবার গন্তব্য কুয়াকাটার সৈকত ধরে পূর্ব দিকে। সমুদ্রকে ডানে রেখে আমরা ছুটে চলেছি লাল কাঁকড়ার চর হয়ে মিশ্রীপাড়া বৌদ্ধ বিহারের দিকে। রোদ নেই বললেই চলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কেওড়া বনের মাথার উপর দিয়ে সূর্য হারিয়ে গেল অজানা ঠিকানায়। আমরা যখন মিশ্রীপাড়ায় পৌঁছাই ততক্ষণে চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে, বিহারের প্রধান ফটক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে বিশেষভাবে অনুরোধ করে আমাদের জন্য বিহারের দরজা আবার খোলা হয়। শত বছর আগে গড়া ৩২ ফুট উচু এই বৌদ্ধ মূর্তিটি একসময় উপমহাদেশের সব থেকে বড় বৌদ্ধ মূর্তি ছিল। যা তৎকালীন সময়ে রাখাইন অধিবাসী মিশ্রী তালুকদার তৈরি করেন। ফলে কালের পরিক্রমায় তার নামেই এই এলাকার নামকরণ হয় মিশ্রীপাড়া হিসেবে।
মিশ্রীপাড়ার বিহার দর্শন শেষে স্থানীয় রাখাইন মার্কেটে কিছুটা সময় ঘুরে ফিরে আসি কুয়াকাটা সৈকতে। সমুদ্রের পাড়ে বসে চলতে থাকে আড্ডা। স্থানীয় এক শিল্পীর কণ্ঠে গান আড্ডায় নতুন মাত্রা যোগ করে। একসময় কথা হয় কুয়াকাটা থেকে ৪০ কি.মি গভীর সমুদ্রে ‘চর বিজয়’ এর আবিষ্কারের সাথে যারা জড়িত ছিলেন তাদের সাথে। ভাবতেই শিহরিত হচ্ছিলাম আমরা। যে চরের হাজার হাজার গাঙচিল মানুষ দেখলে না কি মোটেও ভয় পায় না। ভয়ে উড়ে পালায় না। আরো রয়েছে হাজার হাজার লাল কাঁকড়ার বাস। এভাবেই সমুদ্রের ঠা-া বাতাসে আড্ডায় আড্ডায় সময় গড়িয়ে যেতে থাকে। এরই মাঝে দলের কেউ কেউ আবার ব্যস্ত হয়ে যায় টুকটাক কেনাকাটায়। এমন সময় হঠাৎ প্রচ- ঝড়ো বাতাসে সেদিনের মতো আড্ডা ফেলে হোটেলে ফিরে আসতে হয় আমাদের।
তৃতীয় দিন, পহেলা বৈশাখ। পরিকল্পনা ছিল মেয়েরা একরকম শাড়ি আর ছেলেরা একরকম পাঞ্জাবি পরার। কিন্তু প্রচ- গরমে আর সে পথে হাঁটা হয়নি আমাদের। তবে গরম যতই থাক সমুদ্রে নামা কি আর আটকে থাকে? ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করতে করতে কখন যে দুপুর গড়িয়েছে সেদিকে আমাদের খেয়াল ছিল না। সালেহ যখন আমাদের মনে করিয়ে দেয় তখন পেটজুড়ে ক্ষুধার রাজ্য। তার পরামর্শেই সবাই মিলে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবারের জন্য চলে যাই লেবুর বনে। যাবার আগেই ফোন করে সালেহ দুপুরের খাবারের সব বন্দোবস্ত করে রাখে। মোটরসাইকেল করে যেতে মিনিট পাঁচেক সময়। পৌঁছে দেখি ভাত, ডাল, লক্ষা মাছের ভর্তা আর সাথে রূপচাঁদা ফ্রাই। জীবনে সুখের মানে একেকজনের কাছে একেক রকম। যেমন আমার কাছে এই এক বেলা খাবারের সময়টুকু ছিল একরকম অনন্য সুখের। ভাবতে পারেন সমুদ্র পাশে বাঁশের খুঁটিতে কোনো রকমে দেয়া চাটাইয়ের ছাউনির নিচে বসে আপনি ভাত খাচ্ছেন। পাশেই জোড়া খালেই মাছ ধরার অলস নৌকা, পায়ের নিচে সমুদ্র সমান বালু, সামনে সমুদ্রের ঢেউ আর সদা ব্যস্ত হোটেলের মালিক কাম বাবুর্চির সব সুস্বাদু টাটকা খাবার।
খাওয়া শেষে সবার তৃপ্তিই বলে দেয় আমরা যা ইট বালুর শহরে খুঁজে ফিরি তা আসলেই রয়ে গেছে এই নড়বড়ে বাঁশের চাটাইয়ের নিচে সরলতায়। আমাদের খাওয়া শেষ হতে হতেই সূর্য নিজেকে আড়াল করার সব প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে। ফলে আবার ছুটে যাই তিন নদীর মোহনার কাছাকাছি ঝাউ বনের পাশে। প্রথম দিনের চাইতে আজকে হাতে কিছুটা বেশি সময় থাকায় সবাই মিলে হারিয়ে যাই সূর্যের সাথে সাথে। কেউ কেউ আবার সমুদ্রের পানিতে পা ভিজিয়ে প্রাণ জুড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। আনন্দ আর ভালো লাগার পাশাপাশি কেমন যেন একটা বিষাদের ছোঁয়া ছিল সবার মধ্যে। এটাই ছিল এবারের কুয়াকাটায় আমাদের শেষ সূর্যাস্ত।
সবাই মিলে কুয়াকাটার প্রধান সৈকতে ফিরে এসে আগের দিনের কিনে রাখা সামুদ্রিক মাছের ফ্রাইয়ের প্রস্তুতি নেই। এর পাশাপাশি একদল ব্যস্ত হয়ে পরে সমুদ্রের পাশে বসে আড্ডা দিতে। আড্ডায় আড্ডায় সময় গড়িয়ে যে কখন রাত ১১টা বেজে গেছে তা যেন কারোই মনে ছিল না। একসময় রাতের আঁধারে আছড়ে পরা সমুদ্রের বিশাল ঢেউগুলো বুকে নিয়ে সবাই রুমে ফিরে আসি। এবার ফেরার পালা। পরের দিন সকালের বাসে বরিশাল হয়ে লঞ্চে ঢাকায় ফেরা। ফিরতে হবে সেই কোলাহল পূর্ণ শহুরে জীবনে। যেখানে চাইলেই সমুদ্রকে পাশে নিয়ে হেঁটে যাওয়া যাবে না কিছুটা সময়। হয়তো এখানেই সমুদ্র সবার থেকে আলাদা। এর মায়া যেন শেষ হবার নয়। বারবার হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে।